দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজননক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ‘হালদা নদী’তে রেকর্ড পরিমান ডিম ছেড়েছে রুই জাতীয় মা মাছ।
রোববার (১৮ জুন ) দিবাগত মধ্যরাত থেকে মা মাছ ডিম ছাড়ার পরপরই প্রায় তিন শতাধিক নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম সংগ্রহ শুরু করেন। সোমবার (১৯ জুন ) ভোরেও দেখা যায় উৎসব মুখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহ করেছেন তারা। হালদার নদীর গড়দুয়ারা, আমতুয়া, নাপিতের ঘাট, আজিমের ঘাট, কেরামতলির বাঁক, কাগতিয়ার মুখ সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিম সংগ্রহ করে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহিদুল আলম জানান, “কিছুক্ষণ আগে নদীতে মাছ পুরোদমে ডিম ছেড়েছে। এখন ডিম সংগ্রহের কাজ চলছে। ডিম সংগ্রহকারীরা উৎসবে আমেজে ডিম সংগ্রহ করছেন। এবারেই রেকর্ড পরিমান ডিম ছেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে হালদার মা মাছ রক্ষায় বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ায় আজ কাঙ্ক্ষিত ডিম পাওয়া গেছে
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষথেকে স্থাপিত ৩টি এবং আইডি এফের ১ টি সহ ৪টি পাকা হ্যাছারী ও কয়েকশ মাটির কুয়ার মাধ্যমে রেনু ফুটানোর কাজ চলছে।
হালদা বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ডক্টর মনজুরুল কিবরিয়া দেশ বর্তমানকে বলেন, আমার ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার রেকর্ড পরিমান ডিম ছেড়েছে রুই জাতীয় মা মাছ। এবার প্রায় ৭’শ ডিম সংগ্রহকারী ৩’শ নৌকা নিয়ে ১৬-১৭ হাজার কেজিরও বেশি ডিম সংগ্রহ করেছেন বলে ধারণা করছি। ২০২১-২২ সালে বৃষ্টিপাত কম ও হালদার পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ত থাকায় ডিম ছাড়তে পারেনি বলেও জানান তিনি।
ডিম সংগ্রহকারী মো. হারুন বলেন, গত প্রায় দেড় মাস ধরে এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আজ আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করতে পারছি। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এবার ডিমের পরিমাণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ সোমবার দিনে আরো ডিম পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান। এর আগে প্রথম দফায় গত ১৮ মে নমুনা ডিম ছাড়লেও আবহাওয়া অনুকূল না হওয়ায় সেবার মা মাছ পরিপূর্ণভাবে ডিম ছাড়েনি।
এদিকে রোববার দিনভর তারা পুরোদমে ডিম ছাড়বে কি ছাড়বেনা এনিয়ে অনেক ডিম সংগ্রহকারী হতাশায় ভুগছিলেন। কারন আর মাত্র দুএকদিন সময় আছে চলমান জো’র এবং এ জোঁ এ মৌসুমের শেষ জোঁ। দুই মাস ধরে অন্য পেশা বাদ দিয়ে তারা ডিমের আশায় নদীতে অবস্থান করছেন। এদিন সকাল থেকে কখনো জোয়ার কখনো ভাটায় কার্প জাতীয় মা মাছের ডিম সংগ্রহে নদীর বিভিন্ন স্থানে তারা নদীতে জাল ফেলে অবস্থান করতে থাকে। দুপুরের দিকে কিছু কিছু স্থানে নমুনা ডিম ছাড়লে আশায় বুক বাঁধে ডিম সংগ্রহকারীরা। অবশেষে রাতে পরিপূর্ণ ডিম ছাড়ে মা মাছ। এই ডিম সংগ্রহ করতে শত শত নৌকা রাতে হালদায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
উল্লেখ্য- প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন (বাংলা মাস চৈত্র থেকে আষাঢ়) কর্ণফুলী ও সাঙ্গুর মতো বিভিন্ন নদী থেকে দেশীয় কার্প জাতীয় মাছ, যেমন: রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালি বাউশ হালদায় আসে এবং সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার জন্য উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত হতে হয়। তাপমাত্রা, পানি, প্রবল স্রোত ও বজ্রবৃষ্টি ইত্যাদি মা মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে। চলতি মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এদিকে জালুবায়ু পরিবর্তন, মা মাছ শিকার, নদী দোষনসহ নানা কারণে মা মাছের ডিম দেয়া কমেছে। ২০২০ সালে হালদা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। পরের দুই বছর তা কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে যায়।
২০২১ সালে হালদা থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয় সাড়ে আট হাজার কেজি। ২০২২ সালে তা আরও কমে হয় সাড়ে সাত হাজার কেজি৷