বিরোধীদের এক দফার আন্দোলনকে গুরুত্ব দিতে না চাইলেও সরকারী দলও মাঠে নামার ইঙ্গিত দিয়েছে। ফলে জুলাই মাসেই রাজনৈতিক ময়দান যে কোন সময় জ্বলে উঠতে পারে। জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে ই্ইউ ও মার্কিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা ঢাকা সফর করবেন। গতকাল ইইউ’র ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল ঢাকা এসে পৌছেছে। তারা সরকার ও বিরোধী দল ছাড়াও সুশীল সমাজ ও অন্যদের সাথেও কথা বলবেন। বিএনপির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, বিদেশিদের কাছে নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন দেখাতেই এক দফার আন্দোলনকে চাঙ্গা করার কৌশল নিয়েছে। তবে সরকারের মন্ত্রী, নেতারা আন্দোলনের নামে বিএনপি যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাহলে কঠোর হাতে দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সংলাপ অনুষ্ঠানেও সরকার এক পা আগায় তো দুই পা পিছিয়ে আসছে।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। এর পর ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গত ৩০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অংশ নিলেও পরে যুগপৎ কর্মসূচিতে দলটিকে দেখা যায়নি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনবিষয়ক ছয় সদস্যের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের সঙ্গে দলটির প্রতিনিধি দলের বৈঠকের কথা রয়েছে। তাদের সঙ্গে বৈঠকের আগেই সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইইউ প্রতিনিধি দলের কাছে বিএনপি বার্তা দিতে চায়, সরকার পতনের আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে নেমেছে।
আগামী ১২ জুলাই সরকারবিরোধী একদফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে যাচ্ছে বিএনপি। রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘বিশাল সমাবেশ’ থেকে এ ঘোষণা দেবে দলটি। এ জন্য বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে সার্বিক প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শনিবার নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের (ভার্চুয়ালি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রায় এক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার সভায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়। নয়াপল্টনের এই বৈঠকের পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের ভাড়া বাসা ফিরোজায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর রাতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়।
বৈঠকসূত্রে জানা যায়, আগামী ১২ জুলাই একই দিনে সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট নিজ নিজ প্ল্যাটফর্ম থেকে একদফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থাকবে কিনা, এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী কী করবে, সে বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
এদিকে,গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা জেলা বিএনপিও আজ সোমবার থানা ও পৌর কমিটির বৈঠক আহ্বান করেছে। নির্দেশনা পাওয়ার পর অন্যান্য জেলা ও মহানগর কমিটিও কাজ করছে বলে জানান ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ।
অন্যদিকে, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে আজ সোমবার মতবিনিময় সভা আহ্বান করেছেন। ঢাকা বিভাগের প্রতিটি জেলা মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সুপার ফাইভ নেতাদের আহ্বান করা হয়েছে।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানিয়েছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে আবেদন করা হয়েছে। এ জন্য আজ অথবা কালকের মধ্যে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের ডিএমপিতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত শুক্রবার রাতে হঠাৎ করে তাদের জানানো হয় দলের শীর্ষনেতা তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তারুণ্যের সমাবেশে অংশ নিতে ততক্ষণে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা সিলেটে অবস্থান করছিলেন। বৈঠকে অংশ নিতে দ্রুত তারা ঢাকা ফেরেন।
বৈঠকসূত্র জানায়, প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও জেলা ও অঙ্গসংগঠনের একজন করে শীর্ষনেতা বক্তব্য রাখেন। বৈঠকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদও অংশ নেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা বলেন, কর্মসূচিতে ব্যাপক লোকসমাগমের প্রস্তুতি নিতে সবার নজর দিতে বলা হয়েছে। ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে যেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব।
এদিকে রাতে স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সমমনা জোট ও দলগুলোর কর্মসূচির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। প্রস্তাবে হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ ও ঘেরাওসহ লাগাতার নানা কর্মসূচির প্রস্তাব রয়েছে। তবে বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো সহিংসতার কর্মসূচিতে যেতে চায় না। অহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করতে চায়। পরিস্থিতি বাধ্য করলে কঠোর কর্মসূচিতে যাবে দলটি। কিন্তু ১২ জুলাই কী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলটির নেতারা বলেন, রাজপথের সম্পর্কের ভিত্তি ধরে একমঞ্চে ওঠার পক্ষে বিএনপি। আজ সোমবার গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক আছে। ওই বৈঠকে সম্মিলিত বিরোধী দলের রাষ্ট্র মেরামতের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আলোচনা হবে।
এদিকে বর্তমান সরকারকে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচার বলে আখ্যা দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের আমির তথা চরমোনাইয়ের পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। তিনি বলেছেন, ‘রাতের ভোটের অবৈধ সরকারের পতন ঘটিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।’ এ দাবি আদায়ে আগামী ১৫ জুলাই ঢাকায় সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন চরমোনাইয়ের পীর। ছাড়াও ১৬ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে থানায় উপজেলায় তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলন, সেপ্টেম্বরে সব জেলা ও মহানগরে সমাবেশ করার ঘোষণা দেন।
বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক মিত্রদের আন্দোলনকে জগাখিচুড়ি আন্দোলন আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কদের বলেছেন, বিএনপির আন্দোলনের সাথে জনগণ নেই। জনগণ তাদের আন্দোলনে সাড়া দিচ্ছে না। তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলনের পতন হবে, সরকার থাকবে।
তিনি আরো বলেন, আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির আন্দোলনকে রাজপথে মোকাবেলা করা হবে।
এদিকে বিএনপির এক দফার আন্দোলনকে রাজপথে মোকাবেলা করার প্রস্তুতিও গ্রহণ করছে আওয়ামী লীগ। খুব শিগগির সারাদেশে যুব সমাবেশসহ আগস্ট মাস জুড়ে কর্মসূচী চূড়ান্ত করছে আওয়ামী লীগ। তারা বিএনপির এক দফার কর্মসূচীর বিপরীতে শান্তি সমাবেশ করবে সারাদেশে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আট বিভাগে সহযোগী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সমাবেশ করা হবে। তবে এখনো কর্মসুচি চূড়ান্ত হয়নি। শিগগিরই একটা বৈঠক করে চূড়ান্ত করা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি কী করবে, এটা নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়। তাদের পুরো মনোযোগ এখন নির্বাচনের দিকে।
গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাৎবার্ষিকীতে জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষে নিরাপত্তা বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আগস্ট মাসকে সামনে রেখে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের নামে কেউ যদি হত্যার পরিকল্পনা করে, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গিগোষ্ঠী বলুন, আর স্বাধীনতাবিরোধী বলুন; এসব দল যারা নাকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে, তারা আগস্ট মাসকেই বেছে নেয়। আমরা ১৫ আগস্ট দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বরণ করার দৃশ্যটাও আপনারা দেখেছেন। ২১ আগস্ট আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বোমায় উড়িয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। ৬৩ জেলায় বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কাজেই আগস্ট মাস তাদের প্রিয় মাস। সবসময় তারা এই আগস্ট মাসকেই বেছে নেয়। এক দফার আন্দোলনের নামে আমার মনে হয় সে ধরনের ইঙ্গিত তারা দিচ্ছে কিনা তারাই জানেন।’
এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অবাস্তব দাবি নিয়ে সংলাপের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না । তিনি বলেন, ‘নির্বাচনই সমাধান। নির্বাচন হবে। আমার মনে হয় না অবাস্তব দাবি নিয়ে সংলাপের কোনো প্রয়োজন আছে। আমি পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন কোনো সংলাপ হবে না।’
গতকাল রোববার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে সহকারী জজদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এ রণসাজ নিয়ে রাজনৈতিক পর্য়বেক্ষক মহল সতর্ক রয়েছে। তারা মনে করেন, দুই পক্ষকে এক করা কূটনীতিকদের পক্ষে সহজ হবে না। দুই পক্ষই রাজপথে যে কোন সময় মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। তখন পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় এখনই কোন মন্তব্য করা যাবে না। তবে যে কোন সময় যে কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজপথে জ্বলে উঠতে পারে রাজনীতির অঙ্গন।
এমএইচএফ