‘মদন লাগবে..মদন’ গুড় ও বাদাম দিয়ে তৈরি মদন। এরকম হাঁক-ডাক দিয়ে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাড়া-মহল্লা ও হাট-বাজারের রাস্তায় কাঁধে বাক নিয়ে ফেরি করে মদন বেচেন বৃদ্ধ কাঞ্চন কুমার কুন্ডু (৬৭)। প্রতিদিন বিকেল ৩টায় গুড় ও বাদাম দিয়ে তৈরি মদন নিয়ে জীবীকার জন্য যুদ্ধ শুরু হয় তার। মদন বেচা না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরেন না। কোনোদিন রাত দশটা আবার কখনো এগারটা বাজে মদন বিক্রি করতে। মদন বিক্রি করে তাঁর আয় হয় দুইশত থেকে আড়াই শত টাকা।
একসময় নামকরা রসগোল্লার কারিগর ছিলেন বৃদ্ধ কাঞ্চন কুমার কুন্ডু তিনি গুরুদাসপুর পৌর শহরের বকুল তলা ঘাটের স্বর্গীয় অনীল কুন্ডুর জেষ্ঠ্য ছেলে। তখন তার সবই ছিল। কিš‘ সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব। তাই পেটের দায়ে বুড়ো বয়সে কাঁধে বাক নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে মদন বেচে যা আয় হয় তাই দিয়ে চলে তার সংসার।
কাঞ্চন কুমার কুন্ডুর বয়সের কারনে শরীরও ভার হয়ে গেছে। কন্ঠেও জড়তা এসেছে। কিন্তু জীবীকা নির্বাহ করতে বিকল্প ব্যবস্হা নেই তাঁর। যে বয়সে আরাম আয়েশে থাকার কথা, সেই বয়সে রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে মদন বেচতে হয় তার। তাঁর মদন মদন চিৎকারে অনেকে বিরক্তবোধ করেন, কেউ মজা করতে গিয়ে বাক ধরে টান দেয়, ঢিল ছোড়ে-ক্ষেপায়। তখন তিনি তাদের গালমন্দও করেন। তাঁর গায়ের পোষাক পুরাতন এবং কিছুটা অপরিস্কারও। এজন্য সবাই তাঁর মদন কিনে না। কিছু উৎসুক শিশু তাঁর খরিদ্দার। তবে কিছু মানবিক মানুষ ই”ছা না থাকা সত্বেও সাহায্য করার নিমিত্তে তাঁর মদন কিনে থাকেন।
বৃদ্ধ কাঞ্চন কুমার কুন্ডু বলেন, “আমি পেটের দায়ে বুড়ো বয়সে ফেরি করে মদন বেচি। আমার ছেলে চঞ্চল কুন্ডু এসএসসি পরীক্ষার্থী। স্ত্রী মুক্তা রানী (৫৬) দুটো ছাগল ছানা পোষেন। বিকেলে কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি করেন। তাতে প্রতিদিন আয় হয় পঞ্চাশ টাকা। তিনি আরো বলেন আমারও একসময় বড় মিষ্টির দোকান ছিল। তখন যশ-খ্যাতি আয় ভালোই ছিল। ভাইবোনদের ভরন পোষন করতে গিয়ে তিনি পদে পদে বিপদগ্রস্হ হয়েছেন। এখন তিনশতক জায়গার ওপর দু’টি পুরনো টিনের ঘর ছাড়া আমার কিছুই নেই। বাবা-মা, ভাইবোনের মধ্যে ছোট বোন ছাড়া সবাই মারা গেছে। এখন তিনি ও তার ছোট বোন বেঁচে আছে। জীবনে সাহায্য বলতে গত দুই বছর ধরে পঙ্গুভাতা ছাড়া কিছুই পায় না তিনি। তাও আবার উ”চরক্ত চাপ, গ্যাষ্ট্রিক ও বাত-ব্যাথার ওষুধ কিনতেই টাকা শেষ হয়ে যায়। স্ত্রী-পুত্র ও বোন নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
বৃদ্ধ কাঞ্চন কুমার কুন্ডু খুব আক্ষেপ করে বলেন কবে থেকে নতুন জামাকাপড় পড়ি না। কারণ জিনিস পত্রের দাম চড়া নতুন পোষাক কেনার সামর্থ নেই আমার। শরীরটা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে চেকআপ করে সুস্থ’ থাকার স্বপ্ন থাকলেও তা আমার জন্য দুঃস্বপ্ন। এসব দুঃখের কাহিনী বলতে গিয়ে চোখে তাঁর নোনা জল এসে যায়। থাকেন “যাই-গো দাদা, মদন বেচতে হবে” এই বলেই ‘মদন লাগবে..মদন’ চিৎকার করে রাস্তা দিয়ে আবার চলতে থাকেন ফেরিওয়ালা বৃদ্ধ কাঞ্চন কুমার কুন্ডু।