বিশাল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। বাজেটে ব্যয়ের অঙ্ক যেমন বড়, তেমনি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বেশ বড়। বিশাল এই ব্যয় মেটাতে পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয় আহরণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর এই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ককর বা পরোক্ষ কর হিসেবে ভ্যাটের পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে।
বর্তমানে নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দামে সাধারণ মানুষ জীবন জীবিকা চালাতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। সংসারের খরচ মেটাতে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষেরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছে। এই অবস্থায় বাজেটে নতুন করে নিত্যপণ্যে শুল্ককর বা ভ্যাট যা পরোক্ষ কর নামে পরিচিত, এর পরিধি আরও বাড়লে তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বেন তারা। বর্তমান বাজেট চলমান আয় বৈষম্যকে আরেক দফা উসকে দেবে।
পরোক্ষ করের হার বাড়ার অর্থ হলো, দরিদ্র মানুষের প্রতি অবিচার করা। কারণ একজন ধনী বেশি আয় করেও যদি দরিদ্রদের সমান ভ্যাট দেন যা দরিদ্রদের প্রতি সুবিচারে বড় প্রতিবন্ধক। এই পরোক্ষ কর সমাজের সচ্ছল অংশের তুলনায় নিম্নবিত্ত দরিদ্র মানুষের আয়ের বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। এতে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরও বাড়ছে।
বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য সুখবর না থাকলেও কলম থেকে শুরু করে ফেসিয়াল টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, সিমেন্ট, কাজু বাদাম, বাসমতি চাল, চশমা, মাইক্রোওয়েব ওভেন, এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, প্লাস্টিকের পাত্র, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, সিগারেট, জর্দা-গুল, খেজুর, বিদেশি টাইলস ও মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুধু নিত্যপণ্যই নয়, আগামীতে সংসার খরচের পাশাপাশি বাড়বে ভ্রমণ খরচও। স্থলপথে বিদেশ যেতে একহাজার টাকা ও নৌপথে একহাজার দুইশত টাকা কর দিতে হবে। আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে দুই হাজার টাকা, অন্য দেশ ভ্রমণে চার হাজার টাকা দিতে হবে।
আবার অসংখ্য মানুষ করজালের আওতায় আনতে এবার শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে রিটার্ন জমার স্লিপ (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) নিতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে বিনা পয়সায় আগামীতে রিটার্ন জমা স্লিপ (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) পাওয়া যাবে না।
করোনার পর থেকে দেশের বাজারে ডাল, চাল, আলু থেকে শুরু করে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম ব্যাপকহারে বেড়েছে। বাজার সরবরাহ ঠিক থাকলেও সিন্ডিকেটের কারণে লাফিয়ে বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের দাম। করযোগ্য আয় না থাকলেও আগামীতে রিটার্ন জমা স্লিপ নিতে দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না। এরমধ্যে রয়েছে-ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, সঞ্চয়পত্র কেনা, ব্যাংক ঋণ, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন ও বাড়ির নকশা অনুমোদনের মতো সেবা।
করোনার পর থেকে দেশের বাজারে ডাল, চাল, আলু থেকে শুরু করে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম ব্যাপকহারে বেড়েছে। বাজার সরবরাহ ঠিক থাকলেও সিন্ডিকেটের কারণে লাফিয়ে বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের দাম। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে উল্টো ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে কিছু কিছু পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। যার প্রভাবে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে প্রান্তিক আয়ের মানুষের ভোগান্তির মাত্রা চরমে পৌঁছেছে। ট্যারিফ কমিশন, ভোক্তা অধিকার কিংবা টিসিবি কোনো প্রতিষ্ঠানই বাজার মূল্যে প্রভাব রাখতে পারেনি।
বিদেশি মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সংকটের কারণে সরকার জরুরি অনেক পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এতে সরবরাহজনিত সংকট তৈরি হয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম। এমন পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, নিত্যপণ্য আর জ্বালানিতে ভয়াবহ সংকটে আছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের মে মাসের মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। রেকর্ড মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শুধু আমদানি পণ্যে নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্য ঘিরেও নানান সিন্ডিকেট সক্রিয়। এসব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সব খাদ্য-পণ্য।
সম্প্রতি পেঁয়াজের সংকট, লোডশেডিং বাড়লে রিচার্জাবেল বাল্ব, ফ্যান আইপিএস নিয়ে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারসাজির মতো ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকার বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বিগত বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চমূল্যে খাদ্য-পণ্য কিনতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের চাপ এবং আমদানির পুরানো দায় পরিশোধের চাপে বেসামাল হয়ে পড়ে সরকার। নানা রকম শর্ত মেনে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয় বাংলাদেশকে। সংস্থার কাছ থেকে সাড়ে তিন বছরের কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলার ধারের প্রথম কিস্তি পেলেও দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং আইএমএফের কঠিন শর্তের কারণে রিজার্ভ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে গিয়ে আমদানি সীমিত করে আনতে হয়েছে।
এখন গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে খরচ করতে হচ্ছে বেশি। যেটি কয়েক মাস আগেও গ্রামে ছিল বেশি। ব্যয়ের চাপ সামলাতে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।
ডলার খরচের ক্ষেত্রে জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখন জ্বালানি না কিনে যদি রিজার্ভ বাড়ানোর চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি করতে পারছেন না। কারণ তারা উৎপাদন করতে পারছেন না। তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ও কমে যাবে। তখন রিজার্ভে অন্য সমস্যা আসবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজস্ব নীতি এবং মুদ্রানীতি দুটোই ব্যবহার করতে হবে।
এখন টাকার সরবরাহ যা আছে তা কমাতে হবে। সুদহার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। আর যেসব জায়গায় প্রয়োজন আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্যপণ্য আমদানিতে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে। পরোক্ষ করের মাত্রা কমানোর জন্য প্রত্যক্ষ কর আদায়, ধনী, কর্পোরেট গ্রুপগুলোর কর আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে। ধনীদের সম্পদ করের আদায়ে আরও জোর দিতে হবে।
অতিমুনাফাকারী ব্যবসায়ীদের তালিকা করে অতিরিক্ত মুনাফার ওপর ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তারা কমদামে পণ্য এনে দ্বিগুণ থেকে শুরু করে দশগুণ পর্যন্ত লাভ করছে। অতি মুনাফার ওপর কর আদায় সঠিকভাবে হলে জাতীয় রাজস্বও বাড়বে এবং এধরনের মানসিকতাও নিরুৎসাহিত হবে। দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের বেলায় উৎপাদন কত, চাহিদা কত এগুলো ঠিকমতো পর্যালোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময়মতো আমদানি উন্মুক্ত করা, প্রয়োজনে বন্ধ করা বিধানগুলো দ্রুত কার্যকর করতে হবে।
মূল্যস্ফীতির এমন সব পরিস্থিতিতে টিসিবির মাধ্যমে বিতরণকৃত ফ্যামিলি কার্ডের সংখ্যা ও পরিধি বাড়াতে হবে। যাতে করে সংকটকালীন সময়ে বাজারে বিকল্প সরবরাহ বাড়ে এবং প্রয়োজনে খাদ্য বিভাগসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর উদ্যোগে খোলাবাজারে বিক্রি বাড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)