গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে, ৯ বছর পর প্রধানমন্ত্রী

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক নাম বেগম খালেদা জিয়া। শুধু কি দেশের ইতিহাসে? নিতান্ত অনিচ্ছায় দলীয় নেতাকর্মীদের বহু চেষ্টা-সাধনার পর রাজনীতিতে আসেন তিনি। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসার ৯ বছরের মধ্যে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী। এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর আছে কয়টা?

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে দেখা যেত। রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রমে কখনোই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুই সন্তান আর সংসার নিয়েই ছিল তার জীবন। নিতান্ত একজন গৃহবধূ ছিলেন। রাজনীতিতে এসে হয়ে ওঠেন আপসহীন দেশনেত্রী। তার নেতৃত্বে ফের ক্ষমতায় আসে বিএনপি। বাংলাদেশে প্রথম নারী হিসেবে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়ে কারাবরণ করতে হয়। ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশে কারাগারে তিনি সুষ্ঠ স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হন। শারীরিকভাবে হয়ে পড়েন প্রায় অচল ও অক্ষম। জীবদ্দশায় ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ও পরিনতি দেখাটাকে খালেদা জিয়ার সৌভাগ্য বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অনেকটা আকস্মিকভাবেই বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন। ঘর-সংসার আর দুই শিশু সন্তান সামলানো নিয়েই তিনি ব্যস্ত ছিলেন। জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তখনও খালেদা জিয়াকে প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যেত না। কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্রব ছিল না তার। সেই হিসেবে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসাটা ছিল চমকপ্রদ ঘটনা।

১৯৮১ সালের ৩১ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। ততদিন পর্যন্ত সাধারণ গৃহবধূই ছিলেন বেগম খালেদা জিয়াস্বামীর মৃত্যুর পরও রাজনীতিতে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

দলের প্রতিষ্ঠাতার আকস্মিক মৃত্যুতে বিএনপিতে নেমে আসে বিপর্যয়। দলের নেতাকর্মীরা হয়ে ওঠেন দিশেহারা। বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীদের একত্রিত করে দল গঠন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। যে কারণে দলে আগে থেকেই ছিল উপদলীয় কোন্দল। জিয়ার মৃত্যুর পর সেই উপদলীয় কোন্দেল আরও প্রবল হয়ে ওঠে।

একদিকে স্বৈরশাসক এরশাদের কোপানল, অন্যদিকে দলীয় কোন্দল। সবমিলিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছিলেন, বিএনপির অস্তিত্ব বিলীন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর বিএনপির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। কিন্তু তার বার্ধক্য এবং দল পরিচালনায় উদাসীনতায় তৈরি হয় অসন্তোষ। এ অবস্থায় তৎকালীন বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। তিনি নিজেকে রাজনীতিতে জড়াতে চান না বলে জানিয়ে দেন। দলের নেতা-কর্মীরা রাজনীতিতে আসার জন্য দিনের পর দিন খালেদা জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যান।

বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন, এ বিষয়টি বোঝাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আকবর হোসেন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম শিশু, একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। শেষ পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের দাবির মুখে ঘরের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া।

১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন তিনি।একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৩ সালে মার্চ মাসে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিত সভায় যোগ দেন এবং ভাষণ দেন। ওইসময় বিএনপির চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় র কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি।

এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে আপসহীন নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি নিজেকে চেয়ারম্যান করে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ‘জাতীয় পার্টি’ গঠন করেন এবং ওই বছরের ৭ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিএনপির নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোট যৌথ সভায় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় একাধিকবার খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়। দল হিসেবে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য স্বৈরাচার এরশাদ নিপীড়ন ও বিভাজনের নীতি অনুসরণ করেছিল। এসময় খালেদা জিয়া যে দৃঢ়তার পরিচয় দেন, তা তাকে দেশব্যাপি আপসহীন নেত্রীর মর্যাদা এনে দেয়।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান।রাজনীতিতে আসার ৮ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।