নরসিংদীতে দিন দিন কমতে শুরু করেছে আবাদি জমির পরিমাণ। এসব জমির মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে শিল্প-কারখানা, বাড়ি-ঘর, ইটভাটা, রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কাটা হচ্ছে পুকুর। ফলে আবাদি জমিতে কৃষি পণ্য উৎপাদনে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়।
নরসিংদী জেলা কৃষি বিভাগের আশঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ব্যাপক খাদ্য সংকটে পড়তে হবে এ জেলাকে।
নরসিংদী মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ ও পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্রের তীর বিধৌত প্রাচীনসভ্যতা ও ঐতিহ্যে লালিত জেলা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবস্থানগত কারণে এ জেলা কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। ৩ হাজার ৩৬০.৫৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জেলাটিতে ৬টি উপজেলা, ৬টি পৌরসভা, ৭১টি ইউনিয়ন এবং ১ হাজার ৯৫টি গ্রাম রয়েছে। জেলায় মোট ভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৩ একর। এর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ একর।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুসারে, নরসিংদী জেলার মোট জনসংখ্যা ২৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪৫২ জন। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বাস করেন ১৯ লাখ ৩৯ হাজার ৮২০ জন এবং শহরাঞ্চলে বাস করেন ৬ লাখ ৪৩ জন ৮০৯ জন।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদী জেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮০ হাজার ৭৬০ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলি জমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৯৬১ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ ৩৯ হাজার ৭৬ হেক্টর ও তিন ফসলি জমির পরিমাণ ১২ হাজার ৭৯৬ হেক্টর।
এ জেলার তিন চতুর্থাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। এসব মানুষের জীবন-জীবিকা চলে কৃষি উৎপাদন ও কৃষি বিপণন থেকে। জনসংখ্যা অনুযায়ী মোট খাদ্য শস্যের চাহিদা গড়ে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯৪ মেট্রিক টন, উৎপাদন হচ্ছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার ২২২ মেট্রিক টন। খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে ৩৮ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন। জেলায় গত এক বছরে ৮৫ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। শিল্প কল-কারখানা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি তাঁত শিল্প, ইটভাটা, ঘরবাড়ি তৈরি ও আবাসন প্রকল্পের জন্য জমি ক্রয়/দখল করে বালু দিয়ে ভর্তিকরণ ইত্যাদিই জমি কমে যাওয়ার কারণ ।
এ জেলার কৃষকরা বেগুন, করলা, পটল, শসা, বরবটি, চিচিংগা, ঝিঙা, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, ডাটাশাক, কচু, আলু, ঢেঁড়স, পেঁপেসহ মৌসুম ভিত্তিক বিভিন্ন সবজির চাষ করেন। এছাড়া আউশ, আমন, রোপা আমন, বোনা আমনধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদিত হয় এ জেলায়।
আফাজ উদ্দিন নামে এ জেলার একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন, ইচ্ছেমতো জমির ব্যবহার বাড়ছে। চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কৃষি ও শিল্পের জমি। রাতারাতি খাল, বিল, ডোবা নালা ভরাট হচ্ছে। যেখানে বছরে দু’বার ফসল উৎপাদন হতো। বর্ষায় জমতো থৈ থৈ পানি। এলাকার সাধারণ মানুষ এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ সংগ্রহ করতো, যা ছিল জীবিকারও উৎস। এখন আর এমন কিছু দেখা যায়না। এসব ফসলি জমিতে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হলেও, এসকল বেশিরভাগ জমিতে কৃষক তিন বার ফসল ফলানো হতো। এমন ফসলি জমিতেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে নানা কৌশলে।
তানভীর আহমেদ নামে স্থানীয় একজন শিক্ষক বলেন- নগরায়ন, শিল্পায়ন ও গ্রামে অপরিকল্পিতভাবে আবাসন নির্মাণের ফলে দ্রুত আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাসন নির্মাণ করতে হচ্ছে। তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এখনই আবাদি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুত ভূমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন নরসিংদী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হলধর দাস বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আবাদি জমিতে অবাধে বাড়িঘর না করে একই স্থানে অনাবাদি জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে অধিক লোকের আবাস সংস্থান করা সম্ভব। তা হলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খাদ্যাভাবের সম্মূখীন হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিলে কৃষি জমি রক্ষা করা সম্ভব।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজুর রহমান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে বাড়ি নির্মাণ না করে গ্রামগুলোকে ছোট ছোট শহরে পরিণত করতে হবে। বহুতল ভবনে একাধিক পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরী। তা না হলে ভবিষ্যতে দেশে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিবে। যার ফলে চড়া দামে বাইরের দেশগুলো থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে।
নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অঞ্জন দাস বলেন, আমি যেহেতু এ জেলায় নতুন এসেছি, এ ব্যাপারে না জেনে কিছুই বলতে পারবো না।