নমনীয় মনোভাব উভয় দলে

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আবারও আলোচনায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে বসানোর দাবি দেশি-বিদেশি সব মহলের। দল দুটি বিপরীত মেরুতে থেকে দৃশ্যত দূরত্ব বজায় রেখে বক্তব্য দিলেও কার্যত ভেতরে-ভেতরে সংলাপের তাগাদা অনুভব করছে উভয়পক্ষই। দেশি ও বিদেশি চাপে উভয় দলই সমস্যা সমাধানে তৎপর। তবে সেই আলোচনার উদ্যোগ কে নেবে, এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণা মূলত দুই দলকে চাপে ফেলেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশে পুরোপুরি গণতন্ত্র চলে এসেছে, এটা এখনো আমরা বলতে পারব না। আরও কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, তখন গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে।’ তিনি বলেন, ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে বারবার। যাঁরা এই প্রসঙ্গ তুলছেন তাঁদের নিজ নিজ দেশের গণতন্ত্রের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। কাউকে খুশি করার জন্য নয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং এটাই সত্য। বিএনপি নির্বাচনে আসুক সরকার এখনো চায়। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশে হবে এটাই চায় সরকার। তবে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, তাও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উল্লিখিত বক্তব্যকে রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল মনে করছেন, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, দেশে সুষ্টু নির্বাচন হবে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে এ বক্তব্যের গুরুত্ব রয়েছে। বিএনপির যে দাবি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকারও বলে আসছে একই কথা। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকবেন তা মানতে নারাজ বিএনপি।

এদিকে সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করার কথাও বলে আসছে বিএনপি। দলটি রাজপথেই ফয়সালার কথা বলছে। তবে গত শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারকেই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটা পথ বের করতে হবে। বিএনপি নেতার এই বক্তব্য দলটির আগের অবস্থান থেকে কিছুটা ভিন্ন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত রোববার সচিবালয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা সংলাপ করতে রাজি আছেন কি না। এরপর আমরা বিবেচনা করব। কারণ, আমাদের রাষ্ট্রপতি একবার ডেকেছিলেন, নির্বাচন কমিশন দুইবার তাঁদের ডেকেছে, তাঁরা আসেননি। তাঁদের মনোভাবটা (অ্যাটিচিউড) কী, সেটা আগে জানান।’

এদিকে গতকাল সোমবার বিএনপির নয়াপল্টনে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশ-পূর্ব বক্তব্যে সরকারকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কথা খুব পরিষ্কার, অবিলম্বে পদত্যাগ করেন। কারণ যত দিন যাবে ততই দেশ ও মানুষের ক্ষতি হবে। ততই গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংসদ বিলুপ্ত করেন। তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার যে নামেই বলেন না কেনো, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তাদের হাতে ক্ষমতা দেন- তারা একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচন করবে। এটাই একমাত্র পথ আর কোন পথ নাই।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণেও রাজনৈতিকভাবে তাঁরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করছে। এমন পরিস্থিতি বিএনপির জন্য সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এবার তাঁরা এই সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে চান না। সে জন্য রাজপথের আন্দোলন জোরদার করার পক্ষপাতী তারাঁ। তবে আন্দোলনে সংঘাত বা সহিংতা এড়ানো যাবে কি না, এসব বিষয়ও তাঁদের আলোচনায় রয়েছে। পাশাপাশি সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায়ের বিষয়টিও বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের কারও কারও চিন্তায় রয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পদক্ষেপের কারণে সরকার বড় চাপে পড়েছে। ফলে সংকটের সমাধান না হলে সরকারের জন্য বিপদ আরও বাড়াতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে চাপ বাড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করা যায় কি না, সে আলোচনাও বিএনপিতে রয়েছে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সংলাপে যোগ দিয়েছিল বিএনপি। সেই সংলাপে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করেনি এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময় দলটির নেতারা করেছেন। পুরোনো সেই অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বিএনপি নেতাদের অনেকে সরকারের সঙ্গে এবার আর কোনো সংলাপ নয় এমন অবস্থানে রয়েছেন। তবে দলটির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে আলোচনা হতে পারে। সেই আলোচনার ভিত্তি হবে নির্দলীয় সরকার।

এদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে দলে কোনো আলোচনা এখনো হয়নি। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদককে এই বিষয়ে বিশেষ কোনো দায়িত্ব দিয়েছেন কি না, সেটাও নিশ্চিত নয়।

আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, সংবিধানের ভেতরে থেকে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি আলোচনা বা সংলাপ চাইলে সেটা হতে পারে। তবে সংবিধান অনুযায়ী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। তবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা সম্ভব নাও হতে পারে, এমন আলোচনাও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে রয়েছে।

এদিকে গতকাল সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ এট এ গ্ল্যান্স’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি বিএনপি দেশে একটি গন্ডগোল পাকাতে চায়, বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায়। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই তাদের দাবি এবং আন্দোলনের উদ্দেশ্য, তাই এ নিয়ে সংলাপের কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই।’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে এবং সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার কোনো বাধ্যবাধকতা নাই।’

অন্যদিকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান আলোচনার সম্ভাবনাকে বাতিল না করে দিয়ে বরং রাজনীতিতে সংলাপ হতে পারে বলে দেশ বর্তমানকে জানিয়েছেন। তবে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের আশা দেখেন না জানিয়ে ফারুক খান বলেন, ওদের (বিএনপির) সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সংলাপের নামে বিএনপি শুধু সময়ক্ষেপণ করে। অতীতে দুটি সংলাপ সফল হয়নি। তাই ওদের সঙ্গে সংলাপে আশাবাদী না। চাইলে বিএনপি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ করতে পারে।

এমএইচএফ