২০২৩: দৃশ্যমান উন্নয়নের বছর

শেষ হয়ে এল ২০২৩। পৃথিবীতে কত বদল হয়েছে এ বছরে, ঘটেছে কত পরিবর্তন নানান দেশে, সমাজে। বাংলাদেশের ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০২৩ অনেক ঘটনাবহুল। রাজনৈতিক উত্তাপ, অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি- সব মিলিয়ে ঘটনাবহুল ছিল ২০২৩ সাল। এছাড়াও ২০২৩ সালে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও। আলোচিত ঘটনার পাশাপাশি বছরজুড়ে বাজার সিন্ডিকেটের অপতৎপরতায় অস্থির ছিল নিত্যপণ্যের বাজার। ডেঙ্গুতে রেকর্ডসংখ্যক মানুষের মৃত্যু, বায়ু ও পরিবেশ দূষণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ২০২৩ সাল ছিল ঘটনাবহুল। বিদায়ী বছরে বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে যাত্রা করে বাংলাদেশ।

মেগা যোগাযোগ যুগে প্রবেশ

অবকাঠামো খাতে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক সৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটেছে এ বছর। এ বছরই টানেল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের রেল যোগাযোগেও নবযাত্রা ছিল এবার। ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ চালু হয়েছে। রেলগাড়ির মাধ্যমে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের সংযোগ যোগাযোগের ইতিহাসে নতুন এক মাত্রা। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের পুরোটা সচল হয়েছে, যা শহরের যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এবারই ঢাকা প্রথমবারের মতো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। রেলপথ, সড়কপথের পাশাপাশি আকাশপথের জন্য সুখবর ছিল এবার। কারণ, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের ‘সফট ওপেনিং’ করা হয়েছে অক্টোবর মাসে। বছর শেষে এসে সমুদ্রবন্দর ঘিরেও আশাজাগানিয়া ব্যাপার রয়েছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় সৌদি আরবের একটি কোম্পানি যুক্ত হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

রাজনীতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিএনপির নির্বাচন বর্জন ও রাজপথের আন্দোলন, নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন, আমেরিকার ভিসানীতি, ড. মোহাম্মদ ইউনুস, নির্বাচনী তফসিলসহ আলোচিত বছরের নাম ২০২৩। মানবাধিকার ও নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ টানাপোড়েন, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন, হরতাল অবরোধের কর্মসূচি এবং আওয়ামী লীগের পাল্টা শান্তি সমাবেশের কর্মসূচিতে সরগরম ছিলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। শুরু থেকেই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা তৎপরতা ছিলো। সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি নিয়ে ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকে বিএনপি। বিএনপির সমাবেশের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু উভয় পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ব্যাপক সংঘর্ষ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। মহাসমাবেশে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী-লীগ নেতাকর্মীরা হামলা করেছে অভিযোগ করে সাড়ে তিন বছর পরে হরতাল আহ্বান করে বিএনপি। এতে জামায়াতে ইসলামীও সমর্থন দেয়। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সারা দেশে শান্তি সমাবেশ ও মিছিল করার কথা জানায় আওয়ামী লীগ। অক্টোবর মাসের শেষ থেকে বিএনপি ধারাবাহিক আন্দোলন ঘোষণা করে গেলেও তার মধ্যেই সাত জানুয়ারি নির্বাচনী তফসিল প্রকাশ করে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন।

অর্থনীতি

অর্থনৈতিক ইস্যুতে ২০২৩ সাল ছিলো খুব সংকটপূর্ণ বছর। গত এক দশকে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি আর এতটা সংকটপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়েনি। মূল্যস্ফীতিতে ছিল বিশাল চাপ। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল অস্থিতিশীল।

কোনো মাসে ভালো, কোনো মাসে খারাপ, যা স্বস্তি দেয়নি। সবচেয়ে বড় অস্বস্তি ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। এ বছর দৃশ্যমান হয়েছে ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুরতা। খেলাপি ঋণ থেকে শুরু করে আর্থিক খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। এসব ব্যাপারে শক্তিশালী অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতি যে ১০ শতাংশ আছে তা একটি স্থিতিশীল অবস্থা। ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বেসরকারি খাত যে বিনিয়োগ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে সেই জায়গায় বড় ধরনের সমস্যা আছে। নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বড় ধরনের সংস্কার।

ব্যবসা-বাণিজ্য

জ্বালানি-বিদ্যুৎ আর গ্যাসসংকটের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ২০২৩ সাল। এক পর্যায়ে ভেঙে পড়ে সরবরাহ লাইন, বাড়ে পণ্যের উৎপাদন খরচ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও কাঁচামাল আমদানির সংকট প্রকট হয়ে পড়ে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতাও বড় ধরনের ধাক্কা দেয় দেশের শিল্প-বাণিজ্যে। ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯-৬ শতাংশ উঠিয়ে দেওয়ায় নতুন করে ঋণ পেতে ভোগান্তিতে পড়েন ব্যবসায়ীরা। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা তৈরি হয়।  তবে গত কয়েক বছর দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল ছিল, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি।

নারী

বিগত বছরগুলোর মতো বিদায়ী বছরেও ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন, সালিশ ও ফতোয়াসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে একক ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৫৭৩ জন নারী। জলতি বছর দেশে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন পাঁচজন। এছাড়া ২০২৩ সালে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ১২৯ জন। তাদের মধ্যে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যার শিকার হয়েছেন তিনজন আর ধর্ষণচেষ্টার কারণে আত্মহত্যা করেছেন তিনজন। আর যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৪২ জন নারী। এদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২২ জন পুরুষ। আর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ খুন হয়েছেন।

খেলা

সাফল্য-ব্যর্থতায় মোড়ানো একটি বছর পার করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। নিঃসন্দেহে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় সাফল্য ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের এশিয়া কাপ বিজয়। এদিকে দারুণ একটি বছর পার করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে একটি সিরিজ ১-১ ড্র পাশাপাশি সাফল্যের সঙ্গে এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জিতে নেয় তারা। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজে ২-১ ব্যবধানে জয়, দক্ষিণ আফ্রিকার নারী ক্রিকেটারদের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের স্বাদ পায়। টি-টোয়েন্টি সিরিজ ১-১-এ ড্র করে তারা। শেষ দিকে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ভালো করলেও চলতি বছরটি সাফল্যে রঙিন করার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ওয়ানডে বিশ্বকাপে টাইগারদের ব্যর্থতা ২০২৩ সালে হতাশ করেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের।