স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য মুসলিম বিশ্বের ঐক্য জরুরি
২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি দিবস। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২৯ নভেম্বরকে ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস হিসেবে গ্রহণ করে। এর ঠিক ১০ বছর পরে ১৯৮৭ সালের ২৯ নভেম্বর ‘ইউনাইটেড নেশনস পার্টিশন প্ল্যান ফর প্যালেস্টাইন’ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর থেকেই মুলত এ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিনি সংহতি দিবস’ হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
এরই প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে ফিলিস্তিনকে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ও নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে ফিলিস্তিনি জনগণ যাতে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, সে লক্ষ্য অনুপ্রাণিত করতে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস প্রতিবছর পালিত হয়ে থাকে।
ফিলিস্তিন পরাধীনতার শৃঙ্খল পরা একটি যুদ্ধাহত দেশ। ইহুদি সাম্রাজ্যবাদ থেকে নিজ দেশ বাঁচাতে যারা প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলছে। ফিলিস্তিনের ইতিহাস থেকে জানা যায় রাষ্ট্রটি এক সময় প্যালেস্টাইন নামেও পরিচিত ছিল, তখন এর লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ। এই লোকসংখ্যার তিন ভাগের দু’ভাগ ছিল আরব জাতিভুক্ত মুসলমান, একভাগ ছিল ইহুদি। লীগ অব নেশন্স-এর ম্যান্ডেট অনুসারে চলা ব্রিটিশ শাসনভূক্ত দেশটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদীদের চক্রান্তে ব্রিটিশ রাজ্য প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করা হয় কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরকে আন্তর্জাতিক শহরের মর্যাদা দিয়ে ‘ফিলিস্তিন’ ভূ-খন্ডকে আরব ও ইহুদি অধ্যুষিত দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু এ চক্রান্তের ফলে ফিলিস্তিনের একাংশে ইসরায়েল নামে একটি ভূঁইফোড় ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন তো দূরের কথা, তারা নিজ আদি নিবাস থেকে বিতাড়িত হতে থাকে। তখন থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আরব ও ইহুদি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, বর্তমানে তা বিশ্ব সংকটের রূপ নিয়েছে। বর্তমানে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতায় পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। ইসরায়েলের সাথে বৈরি সম্পর্ক ছিলো এমন অনেক মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বলছে এ ধরনের সম্পর্ক স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় এবং তাদের মূল দাবী ১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধের অবৈধ দখলকৃত জায়গা ইসরায়েলকে ছেড়ে দিতে
বিগত ৭৫ বছরের রক্তস্নাত পথ ধরে ইসরায়েল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটির জন্মলাভের পর থেকেই তার ভিতরে লুকানো পশুবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ক্রমেই ঘটতে থাকে। ১৯৪৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৫ বছরে ইসরায়েল যে বর্বরতা ও পাশবিকতা দেখিয়েছে তা মানুষ কোন দিন কল্পনাও করেনি। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ইসরায়েল যুদ্ধের সময় পশ্চিমতীর জর্ডানের এবং গাজা মিশরের দখলে চলে আসে। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের ভয়াবহ যুদ্ধে ইসরায়েল পুনরায় সেগুলো দখল করে নেয়। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালিয়ে ১৭,৫০০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। ঐ একই বছর লেবাননের শাবরা-শাতিলা গণহত্যায় ১৭০০ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। লেবাননে ইসরায়েলের উপর্যুপরি আক্রমণে ইয়াসির আরাফাত তাঁর পিএলও-এর ঘাঁটি বৈরুত থেকে তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিসে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় কিন্তু তারপরও ১৯৮৬ সালে ইসরায়েল তিউনিসেও হামলা চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করে। এরপর ১৯৯৬ সালে কানা গণহত্যায় ১০৬ সাধারণ লেবাননী জনগণ নিহত হয়। এরা ছিল জাতিসংঘ আশ্রিত এবং নিহতদের অনেকেই ছিল শিশু। ২০০৬ সালে তারা লেবাননের মারওয়াহিন গ্রামের অধিবাসীদের ঘরবাড়ী ছেড়ে চলে যেতে বলে এবং সবাই তা মেনে নিয়ে রাস্তায় নামতেই হেলিকপ্টার থেকে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২০০৭ সাল থেকে হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ২০০৮-০৯, ২০১২ ও ২০১৪ সালে ইসরায়েলি সেনার সঙ্গে হামাসের তুমুল লড়াই চলে। হামাস ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার সম্মিলিত অঞ্চলের উপর একটি ইসলামী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র চায় এবং পশ্চিমাদের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান প্রত্যাখ্যান করে।
সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ গাজার সীমান্ত সংলগ্ন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের নজিরবিহীন হামলায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে বলে দেশটি জানিয়েছে। এ সময় হামাস ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৪০ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে আসে। অন্যদিকে হামাসের হামলার পরপর ওই দিন থেকেই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় ব্যাপক ও ভয়াবহ হামলা শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। ৪৮ দিন ধরে তাদের অবিরাম হামলায় গাজার বাসিন্দা ১৪৫০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয় যার প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু।
এবার হামাসের অতর্কিত ও আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে এবং হামলার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। এর বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে ইরান ছাড়া আর কোন দেশকেই উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে দেখা যায়নি। বরং কাপুরুষের মতো কোন কোন মুসলিম দেশের প্রতিক্রিয়া ছিলো একেবারেই নখদন্তহীন। মুসলিম বিশ্বের জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বা শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো পশ্চিমাদের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি। মুসলমান প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এবং ‘নিপীড়িত’ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসলেও বড় ধরণের সংকট এলে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত ও জোড়ালো অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরায়েলের সাথে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোন ভূমিকা নিতে পারে না, বরং অনেকটা কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে বসে থাকে।
তবে এটা সত্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে ইসরায়েলকে ঘিরে আরব দেশগুলোতে চিন্তার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে। আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে মি. ট্রাম্পের ভূমিকা আর ওই অঞ্চলে ইরানের সাথে বিরোধিতার কারণেই অনেক আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িয়েছে। তবে সব মিলিয়ে এসব কিছুই মূলত ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বকে শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল করে রেখেছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন। আসল কথা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং প্রতিনিধিত্বশীল সরকার মুসলিম বিশ্বে খুবই কম এবং এ ধরনের দেশগুলোর সরকারকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় বলে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই। নিজেদের ক্ষমতাকে তারা চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়। সংগত কারণেই তারা হয়তো মনে করে পপুলার সেন্টিমেন্ট যাই হোক ইসরায়েল বা পশ্চিমাদেরকে ঘাঁটানো তাদের ঠিক হবে না। এ কারণেই তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত দেখা যায় না। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বা নির্বাচনের বালাই নেই। ইসরায়েলের সাথে সমঝোতা বা ভারসাম্য রক্ষা করে চলা তাদের জন্য জরুরি।
মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই দুটি প্রবণতা লক্ষ্যণীয় বেশিরভাগ জনগণই ফিলিস্তিনের পক্ষে কিন্তু সরকারগুলোর কথায় জোর কম। কারণ তাদের অভ্যন্তরীণ ও ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার জটিলতার কারণেই তারা শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে না। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসক পরিবারগুলো ক্ষমতার প্রশ্নে কোন ধরনের আপোষ কখনোই করে না। এসব দেশে গণতন্ত্র বা জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থাও কাজ করে না। তারপরেও অনেকেই মনে করেন লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ার ঘটনার পর আরব দেশগুলোর রাজপরিবারগুলো নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। মুসলিম দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে না। তবে ইরানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু থাকায় দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বলয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে। কিন্তু তুরস্ক বিবৃতিতে শক্ত ভাষা ব্যবহার করলেও নেটোর সদস্যপদসহ বেশ কিছু বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে কৌশলী ভূমিকা নিতে হচ্ছে। এছাড়া অনেক দেশ থেকে আমেরিকান সমর্থন সরে যাচ্ছে, ফলে তাদের জন্য ইসরায়েল সিকিউরিটি গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করছে। ইরান ছাড়া বেশিরভাগ দেশেরই পাশ্চাত্য নির্ভরতা অনেক বেড়েছে এবং সে কারণে তাদের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়।
মোট কথা মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্র নেই, যাও আছে তাও নাম মাত্র এবং এ কারণে এসব দেশের সরকারকে পশ্চিমাদের সাথে সমঝোতা করে চলতে হয়। পশ্চিমাদের চটিয়ে কেউ নিজের ক্ষমতাকে দুর্বল করতে চায় না। মিসর, তিউনিসিয়ার মতো দেশও এর বাইরে নয়। সবাই জানে ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার হলেই পশ্চিমাদের চাপ আসবে এবং এ চাপ সামলান বেশ কঠিন। বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ইসরায়েলের সাথে তাদের সমঝোতা জরুরি। একই কারণে ওআইসি বা আরব লীগও চুপচাপ থাকে। পাশাপাশি রাজতন্ত্রের বাইরে থাকা দেশগুলো- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সোচ্চার হওয়ার মতো প্রভাবই নেই। মূলত মুসলিম বিশ্বের এ সমস্ত অনৈক্যে ও অসহযোগিতার কারণেই “আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিনি সংহতি দিবস” পালিত হলেও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কায়েম করা যাচ্ছে না। এজন্য কার্যকর স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম বিশ্বের ঐক্য জরুরি।