নারু মোয়া ভীষণ পছন্দ করতেন ছেলে বিশ্বজিৎ। তাই প্রতিবছর পুজাতে ছেলের জন্য মা কল্পনা রানী প্রস্তুত করে রাখতেন নারু। বিশ্বজিৎও পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনাকাটা করে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতেন। তবে এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। বিশ্বজিৎ আর বাড়ি ফিরবে না। ছেলের কথা ভাবতেই এখনো নীরবে চোখের জল ফেলে চলছেন মা কল্পনা দাস। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ছেলের হত্যার বিচার চাইতে চাইতে এখন ক্লান্ত তিনি।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির-নেতৃত্বাধীন ১৮-দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের কর্মীরা পুরাণ ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা ভোজেশ্বর ইউনিয়নের মসুরা গ্রামের বিশ্বজিৎ দাসকে। বিশ্বজিৎকে কোপানোর এ ভিডিও দেখে সেদিন আঁতকে উঠেছিল দেশবাসী।
সেই ঘটনায় বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করার পরে ঢাকার দ্রুত বিচার টাইব্যুনালে মামলার রায়ে ২১ জনের মধ্যে ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছিল। মামলাটি হাই কোর্টে গেলে ২০১৭ সালের ৬ অগাস্ট আটজনের মধ্যে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়; দুজন খালাস পান। এছাড়া যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির দু’জন খালাস পান, অপর ১১ জনের যাবজ্জীবন বহাল থাকে।
বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার নিয়ে এখনও তার পরিবারে আক্ষেপ। বিশ্বজিৎ দাসের মা কল্পনা দাস রাইজিংবিডির সাথে আলাপকালে জানান, তার ছেলে কোনো সন্ত্রাসী ছিল না এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। বিশ্বজিৎ ঢাকার শাঁখারীবাজারে দোকান চালাতো, যেখানে সবাই তার বন্ধু ছিল, কোনো শত্রু ছিল না। ২০১২ সালে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে বিশ্বজিৎ বলছিলো, আমি হিন্দু, আমাকে মারবেন না। তবুও রেহাই পায়নি। ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যাকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি বলে জানান কল্পনা দাস। তিনি বর্তমান সরকারের কাছে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানান, যাতে তার ছেলের আত্মা শান্তি পায়।
বিশ্বজিৎ দাসের বাবা অনন্ত দাস জানান, তার ছেলে দর্জির কাজ করে পরিবার চালাতেন। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, যা সবাই দেখেছে। ১২ বছর ধরে বিচারের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখনো কোনো বিচার পাইনি। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে, যা একজন বাবা হিসেবে তার সহ্য করা কঠিন। স্ত্রী প্রতিনিয়ত এ দৃশ্য দেখে কাঁদেন, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তার নেই।
তিনি সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, মৃত্যুর আগে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান বলেন, স্বৈরাচারী সরকারের আমলে ন্যায় বিচার পায়নি পরিবারটি। দীর্ঘ ১ যুগ ধরে বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা। তবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে অতি দ্রুত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে এমনটা প্রত্যাশা করছি।