বর্তমান সময়ে বিশ্ব বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম নিম্নমুখী। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী বছরেই পণ্যের দাম কমে যাবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে। আন্তর্জাতিক বাজারের এই দাম কমার ফলে আমদানির খরচও হ্রাস পেয়েছে। ডলারের দাম কম ও জ্বালানি তেলের দাম কমার কারণে পণ্য পরিবহণের খরচও কমেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব ইতিবাচক পরিবর্তনের পরও বাজারে পণ্যের দাম কমার পরিবর্তে বেড়ে চলেছে। ফলে দুভাবে ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা শুল্ক ও ডলারের মূল্য হ্রাসের সুবিধা উপভোগ করলেও, ভোক্তাদের জন্য জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম কমছে। চলতি বছরের মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম আরও ৯ শতাংশ কমবে। জ্বালানি তেলের দাম কমে প্রতি ব্যারেল ৭৩ ডলারে আসবে। পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দামও কমবে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত পণ্যের দাম কমতেই থাকবে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে আসবে। এ কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচসহ পরিবহণ ব্যয়ও কমে যাবে। এসব কারণে কমে যাবে পণ্যের দামও।
সূত্র জানায়, দেশে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয় তার প্রায় সবগুলোর দামই আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ অন্য পরিবহণ খরচ কমেছে। দেশে ডলারের দামও কমেছে। আগে আমদানিতে প্রতি ডলার কিনতে হতো সর্বোচ্চ ১৩২ টাকা করে। এখন তা কমে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে। এসব কারণে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমদানি পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু দাম কমেনি। উলটো আরও বেড়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ১০৫ ডলার। আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১ ডলারে, সেপ্টেম্বরে আবার কিছুটা বেড়ে ১ হাজার ৪৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে সার্বিকভাবে এর দাম নিম্নমুখী। ডিসেম্বরের তুলনায় সয়াবিনের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। খোলা সয়াবিন তেল এখন প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। যা এক মাস আগে ১৫৫ টাকা ছিল। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। যা এক মাস আগে ১৬৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সব খাতেই সয়াবিনের দাম বেড়েছে।
রাজধানীর মৌলভীবাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু করপোরেট কোম্পানি তেলের দাম কমায়নি। উলটো বাড়িয়ে বিক্রি করছে। তারা আরও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাম অয়েলের দাম কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে চীনে এর চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়েছে। ডিসেম্বরে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম ছিল ৮১৬ ডলার। জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯৬ ডলারে, আগস্টে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩৩ ডলারে। সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৩ ডলারে। ডিসেম্বরের তুলনায় এর দাম বেড়েছে ২০ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এদিকে দেশের বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি লিটার পাম অয়েলের দাম বেড়েছে সাড়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশ। প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ১৪২ টাকা। বোতলজাত পাম অয়েল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫৮ টাকা। যা মাসখানেক আগে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ডিসেম্বরে থাইল্যান্ডের মোটা চালের প্রতি টন ছিল ৫৯৩ ডলার। জুলাইয়ে তা কমে ৫৭০ ডলার, আগস্টে আরও কমে ৫৬৬ ডলার ও সেপ্টেম্বরে আরও কমে দাঁড়ায় ৫৬৪ ডলারে। ডিসেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমেছে ৫ শতাংশ।
ভিয়েতনামে চালের টন ডিসেম্বরে ছিল ৬২৬ ডলার। জুলাইয়ে তা কমে ৫৫২ ডলার, আগস্টে ৫৩৫ ডলার, সেপ্টেম্বরে ৫৪০ ডলারে দাঁড়ায়। আলোচ্য সময়ে এর দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
চালের চাহিদার কিছু অংশ আমদানি করা হয়। বড় অংশই মেটানো হয় দেশীয় উৎপাদন থেকে। তারপরও আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম বাড়লে দেশের বাজারেও বেড়ে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে দেশে এর দাম কমে না। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে।
দেশের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে প্রতি কেজি মোটা জাতের চালের মধ্যে স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। প্রতি কেজি পাইজাম ও বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা। যা এক মাস আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সরু চালের মধ্যে মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি। যা আগে ছিল ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। আলোচ্য সময়ে চালের কেজি গড়ে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।
কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চাল আমদানিতে সরকার শুল্ক কমিয়েছে। পাশাপাশি দেশে চালের সংকট নেই। কিন্তু মিলাররা সরবরাহ কমিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। যে কারণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চাল বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। মিল থেকে নায্য দামে চাল পেলে পাইকারি ও খুচরাতেও দাম কমে যাবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গমের দাম ডিসেম্বরে ছিল ২৪৪ ডলার। জুলাইয়ে তা কমে ২১৯ ডলার, আগস্টে ২০৬ ডলার ও সেপ্টেম্বরে সামান্য বেড়ে ২১৯ ডলারে দাঁড়ায়। আলোচ্য সময়ে গমের দাম কমেছে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ।
কিন্তু দেশের বাজারে আটার দাম কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। খোলা আটা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। এক মাস আগে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি। প্যাকেটজাত আটা আগে ছিল ৫৫ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজি। প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা।
ফার্মের মুরগি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় না। দেশে উৎপাদিত মুরগিই বাজারে বিক্রি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি মুরগির মাংস ১ দশমিক ৫৪ ডলার থেকে কমে জুলাইয়ে ১ দশমিক ৩৩ ডলারে নামে। পরে তা আরও কিছুটা বেড়ে আগস্টে ১ দশমিক ৩৮ ডলার হয়। সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে হয় ১ দশমিক ৪৫ ডলার। এ হিসাবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি মুরগির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১৭৪ টাকায়। আন্তর্জাতিক বাজারে শুধু মুরগির মাংসই বিক্রি হয়। মুরগি প্রসেস করে প্যাকেটজাত মাংস বিক্রি করা হয়। এতে ফেলে দেওয়ার মতো কোনো অংশ থাকে না। কিন্তু দেশের বাজারে প্রতি কেজি ফার্মের জীবন্ত মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা করে। এতে পাখনাসহ অন্যান্য বর্জ্য ফেলে দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকে গড়ে ৭৫০ গ্রাম। এর দাম পড়ে ২১০ টাকা। বর্জ্য হিসাবে ৫২ টাকা ফেলে দিতে হচ্ছে। এ হিসাবে এক কেজির দাম পড়ে ২৬২ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম গত ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৩৭ ডলার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩০ ডলারে। স্থানীয় মুদ্রায় প্রতি কেজির দাম হচ্ছে ৭৫৬ টাকা। দেশের বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। গত সরকারের আমলে কিছু ব্যবসায়ী ৬৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করে আলোচনায় এসেছিলেন। গরু আমদানি করা হয় না। চোরাচালানের মাধ্যমে কিছু গরু দেশে আসে। বাকিটা দেশে উৎপাদিত গরু দিয়েই চাহিদা মেটানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেছে গরুর মাংসের দাম এত বেশি হবে কেন?
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ডিসেম্বরে ছিল দশমিক ৫৪ ডলার, জুলাইয়ে তা কমে দশমিক ৪৩ ডলার, আগস্টে দশমিক ৪১ ডলার, সেপ্টেম্বরে আবার কিছুটা বেড়ে দশমিক ৪৫ ডলার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির দাম পড়ে ৫৪ টাকা। অথচ দেশের বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। যা এক মাস আগে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা ছিল। চিনি আমদানিতে শুল্ক রয়েছে, জাহাজে আমদানিতে ভাড়া লাগছে। এছাড়া বন্দর চার্জসহ অন্যান্য খরচ রয়েছে। এসব মিলে খুচরা বাজারে কি প্রতি কেজিতে ৮১ থেকে ৮৬ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে-প্রশ্ন ভোক্তাদের। এছাড়া খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি বড় দানার মসুর ডাল ১০৫ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা এক সপ্তাহ আগেও ১০৫ থেকে ১১০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি মাঝারি দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা ছিল। ডালের বড় অংশই আমদানি নির্ভর। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ডালের দাম কিছুটা কমেছে।