সবার অংশগ্রহণে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচিত খবর। এখন থেকেই সবার দৃষ্টি সেদিকে। কিভাবে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় নির্বাচনে তা নিয়ে দেশে বিদেশেও আলোচনা কম হচ্ছে না। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের কূটনীতিকরা কয়েকমাস ধরে দৌড়ঝাঁপ করে নির্বাচনের বিষয়টিকে একটি মাত্রায় পৌছে দিয়েছেন। সরকার ও বিরোধী দলের অন্দর মহলে একটা দরকষাকষি চলছে বলে নানা সূত্রের খবরও রয়েছে। তবে এই দর কষাকষির ট্রাম্প কার্ড হতে পারেন বেগম খালেদা জিয়া।
মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে রাজপথে রয়েছে। তবে এই দুইটি প্রধান দাবি বলা হলেও তাদের ঘোষিত ১০ দফার বাস্তবায়ন নিয়েই তাদের চলমান আন্দোলন। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণের জন্য কূটনীতিকদের একটা চাপ রয়েছে সরকারের উপর। সরকার স্বীকার করুক আর না করুক তাদের নানা তৎপরতায় তা প্রকাশ পাচ্ছে। তবে সরকারী দল আওয়ামী লীগও বিএনপিসহ সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে কোন আপত্তি করছে না। সংকট হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে হবে বিএনপিকে। সে ক্ষেত্রে সরকার বিএনপিকে খালেদা জিয়ার মুক্তি বা তারেক রহমানকে বিদেশ থেকে দেশে আসার ব্যাপারে ছাড় দিতেও নমনীয় বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সূত্রটির মতে, বিএনপি বা সরকারী দল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা মাঠে ময়দানে নির্বাচন নিয়ে যা বলছেন তা একান্তই মাঠের বক্তব্য। তারা মানি না মানব না’ যতই বলুক,তৃতীয় পক্ষের কাছে ঠিকই একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কথা জানাচ্ছেন বিশেষ করে কূটনৈতিক পর্যায়ে।
ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাথে বার বার বৈঠকে বসে উভয়ের কথা শুনেছেন। তারা চেষ্টা করছেন দুই বড় দলের মধ্যে একটি সমঝোতা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। তারা এখনো হাল ছাড়েনি। ধারনা করা হচ্ছে নির্বাচন পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
এদিকে গত ৬ জুন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ১৪ দলের এক সভায় বলেন, ‘জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসুক। আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই, কোথায় সমস্যা; সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা কোথায় এবং কীভাবে সেটা নিরসন করা যায়। এটা আলোচনার মধ্য দিয়েই সুরাহা হতে পারে, অন্য কোনো পথে নয়।’
আমুর এ বক্তব্যে রাজনৈতিক মহল যেনো নড়েচড়ে বসে। বরফ এত তাড়াতাড়ি গলছে কিভাবে ? তখন অতীতের সংলাপ আলোচনার বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। কিন্তু পরদিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান,এখনই বিএনপির সাথে আলোচনার সময় আসেনি।
যেহেতু নির্বাচনের আরো কয়েকমাস বাকি রয়েছে, সেহেতু রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের আলোচনা ছিল হয়ত আর একটু পরে আলোচনা করতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তবে আলোচনা হবে না বা বিএনপির সাথে কোন প্রকার সমঝোতা না করে সরকার একতরফা নির্বাচনে যাচ্ছে না তা পরিস্কার হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন বলেছেন, সবাইকে নিয়েই নির্বাচন হবে। বিএনপিও নির্বাচনে আসবে। তাদের নির্বাচনে না আসার কোন বাধা থাকলে আলোচনা করে তা নিরসনের চেষ্ঠা করা হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।
এদিকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবেন।
তিনি বলেন, ‘অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং কন্টিনেন্টাল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে সরকার ইতিপূর্বে দায়িত্ব পালন করে আসছিল তারাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে, আমাদের দেশেও সংবিধান অনুযায়ী তা-ই হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করে বা তারা যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন না করার দাবিতেই অনড় থাকে তাহলে আলোচনার প্রশ্নই আসে না। ২০১৪ সালের প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিএনপিকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু তারা সেটি গ্রহণ করে নাই।’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটি উৎসবমুখর এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নির্বাচন করতে চাই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে বলেছেন, আমরা যুক্তরাজ্যের মতো সুন্দর নির্বাচন করতে চাই। আর সেটি করতে সমস্ত রাজনৈতিক দলের সহায়তা প্রয়োজন।
ড.হাছান মাহমুদ আরো বলেন, ‘আশা করব বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে, উৎসবমুখর পরিবেশে ভালো নির্বাচন করতে সহায়তা করবে। আর আমরা নির্বাচনকে সামনে রেখে কারো সাথে খেলা শুরু করিনি। আমরা নির্বাচনের সময় খেলতে চাই এবং সেই খেলায় বিএনপিকে আহ্বান জানাব। আমরা উনাদের সাথে খেলে গোল দিতে চাই।
এদিকে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফার ভিত্তিতে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও তার মিত্ররা। ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত যুগপৎভাবে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। ওই সময় পর্যন্ত গণমিছিল, গণঅবস্থান, মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে ঈদের পর থেকে বিএনপি ও তার মিত্ররা এককভাবে কর্মসূচি করছে। তারা এসব কর্মসূচিকে যুগপৎ ধারায় দলীয় কর্মসূচি বলছে। এক দফার ভিত্তিতে যৌথ ঘোষণা দেওয়ার পরই শুরু হবে যুগপৎ আন্দোলন। তবে আন্দোলনের কর্মসূচী জোরদারের পাশাপাশি সরকারের সাথেও আলোচনা চালিয়ে নেবে এমন আভাস দিয়েছে দলীয় ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র।
জানা গেছে সমঝোতার পাঁচ দফা প্রস্তাবনা নিয়ে একটি মহলে আড়ালে কথা চালাচালি করছে। তাতে রয়েছে-
১. বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার সুযোগ দান করা।
২. নির্বাচনের আগের মন্ত্রিসভা ছোট করা এবং অন্তত অর্ধেক মন্ত্রী রাখা, যারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না।
৩. নির্বাচন কমিশনকে আরও ক্ষমতা প্রদান করা এবং নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে প্রদান।
৪. নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।
৫. নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনের যত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ রয়েছে তা বাতিল করা এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করা।
এই ৫ দফা প্রস্তাব যদি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় তাহলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে এমন কথা কেউ কেউ বলছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের সমঝোতার একটিই পথ। তা হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি।
তবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের সাথে এই প্রতিবেদকের আলাপে তিনি বলেছেন,নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যদি সরকারের সাথে সমঝোতা হয় তাতে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসার বাধা দূর করার দাবিকে সামনে আনা হতে পারে।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, তারা মনে করছেন, ২০১৮ এর নির্বাচনে যদি খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটিকে নিয়ে দর কষাকষি করা হতো, সেটি তাদের জন্য লাভজনক হতো। কিন্তু সেটি না করে বিএনপির ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। এবার বিএনপি নির্বাচনে যাবার প্রধান শর্ত হিসেবে রাখছে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সমস্ত হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিনিময়ে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে বিএনপির মধ্যেই এক ধরনের মতবিরোধ রয়েছে। তারা মনে করছে, খালেদা জিয়ার শর্তযুক্ত মুক্তি বা নির্বাচনে যাওয়ার শর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তি- এগুলো বিএনপির আরও সর্বনাশ ডেকে আনবে। বিএনপির একমাত্র পথ আন্দোলন তীব্র করা এবং সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করা। কিন্তু সেটি বিএনপি আদৌ অর্জন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে বিএনপির মধ্যে রয়েছে সংশয় সন্দেহ।