বাংলাদেশে ট্যানারি শিল্পে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে অন্যান্য ভারি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি নির্ভর হলেও ট্যানারি শিল্পের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কেননা এর প্রধান কাঁচামাল কাঁচা চামড়া ও লবণ দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও সহজলভ্য শ্রমিক, পরিবহন সুবিধা, ব্যাংক ঋণ সুবিধাসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ আছে এখানে। এই শিল্প বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাময় একটি খাত। বর্জ্য পরিশোধন, ইটিপির ব্যবহার, ডাম্পিং ইয়ার্ড সহ কিছু সংকট মোকাবেলা করতে পারলে ঘুরে দাঁড়াবে এই শিল্পখাত-এমনই মত ব্যবসায়ীদের।
অভিযোগ আছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকলেও ব্যবসায়ীরা ইউরোপের বাজারে সরবরাহ করতে পারছেন না চামড়া। সাভারে চামড়া শিল্পনগরীর সেন্ট্রাল ইনফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) ও ডাম্পিং ইয়ার্ডের সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় এবং অন্যান্য সূচকে অগ্রগতি না হওয়ায় মিলছে না পরিবেশগত মান রক্ষার্থে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ।এতে করে ইউরোপের বৃহৎ দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনছে না। ফলে, দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার।
একসময় বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী গুরুত্বপূর্ণ খাত। দেশের মোট রপ্তানির মধ্যে চামড়া খাতের অবদান ৪%। যা দেশের মোট জিডিপির ০.৫%। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাতের রফতানি সর্বোচ্চ এক হাজার দুইশ ৫৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। পরবর্তী দুই বছর রপ্তানি আয় কিছুটা ঝিমিয়ে গেলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় হয় এক হাজার দুইশ ৩৪ মিলিয়ন ডলার।
২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় সাতশ ৯৭ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় আরো কমে দাঁড়ায় সাতশ ৯৬ মিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে এই শিল্পে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে জানিয়ে বলেন, সরকারের সদিচ্ছা ও সুদৃষ্টিই পারে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ২৩০ টি ট্যানারি রয়েছে। যার মধ্যে চট্টগ্রামে টিকে আছে একটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চট্টগ্রামে ট্যানারি ছিল ২২টি। পরিবেশগত কারণ ও লোকসানে পড়ে বিভিন্ন সময় একে একে বন্ধ হয়ে যায় ২১টি। সর্বশেষ পরিবেশগত ঝামেলায় বন্ধ হয়ে যায় মদিনা ট্যানারি। বর্তমানে চট্টগ্রামে একমাত্র ট্যানারি টিকে গ্রæপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ’রিফ লেদার’। এই ট্যানারির চট্টগ্রামে সংগ্রহকৃত চামড়ার মাত্র দশ শতাংশ কেনার সক্ষমতা আছে। বাকি ৯০ শতাংশই নিতে হয় ঢাকায়। তাছাড়া গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে নতুন করে গড়ে উঠেনি কোনো ট্যানারি। অথচ কাঁচামালের সহজ প্রাপ্তি, সহজলভ্য শ্রমিক, পরিবহন সুবিধা, ব্যাংক ঋণ সুবিধাসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ আছে চট্টগ্রামে।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তরের সব ধরনের নিয়মবিধি এবং গ্রিন কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন করে কালুরঘাটে টিকে আছে রিফ লেদার লিমিটেড নামের চট্টগ্রামের একমাত্র ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি প্রক্রিয়াকরণকৃত পাকা চামড়া রপ্তানিও করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ট্যানারি শিল্পে পরিবেশ সুরক্ষায় অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনসহ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের সব বিধিবিধান বাস্তবায়নে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা বিধিবিধান লঙ্ঘন করবেন, তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের দায়ে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের ও ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ের বিধান বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রæপ সার্টিফিকেট এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ অধিদপ্তরের বার্ষিক ছাড়পত্র গ্রহণ তাই বাধ্যতামূলক।
এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে যে বিধিবিধান রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে না পেরে চট্টগ্রামে অনেক ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে। এসময় তিনি স্পষ্ট করে বলেন, পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো ট্যানারিকে অনুমোদন দেওয়া হবে না।
নগরীর কালুরঘাট শিল্প এলাকায় রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক মুখলেসুর রহমানের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালে ইটিপি বাস্তবায়ন করেছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক কমিটি লেদার ওয়ার্কিং গ্রæপ তাদের কারখানা পরিদর্শন করে গেছে এবং এই কারখানাকে লেদার ওয়ার্কিং গ্রæপ সার্টিফিকেট প্রদান করেছে। দুই বছর পর পর এই কমিটির অডিট গ্রæপ সরেজমিনে কারখানা পরিদর্শনে আসেন। এই সার্টিফিকেট ছাড়া ট্যানারি শিল্প পরিচালনা করা যায় না বলে মত তার।
মুখলেসুর রহমানের বলেন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কমিটি স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের বার্ষিক ছাড়পত্রও দেখতে চায়। আন্তর্জাতিক ওয়ার্কিং গ্রæপের পর্যবেক্ষণে ট্যানারিতে স্বাস্থ্য সুবিধা, ব্যবস্থাপনাসহ আন্তর্জাতিক মানের সব সুযোগ-সুবিধাও দেখতে চায়। ফলে সাধারণ কোনো ট্যানারি শিল্প বা কারখানার পক্ষে এগুলো বাস্তবায়ন অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, রিফ লেদার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তাকে পাকা চামড়ায় বা ফিনিশড প্রোডাক্টে রূপান্তর করে থাকে। তারা প্রতি বছর ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করে থাকে। প্রতি বছর কোরবানিতে প্রায় এক লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকে তাদের। তবে এখন কিছুটা বেড়েছে।
এসময় ইটিপি বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, একটি ট্যানারিতে ইটিপি বাস্তবায়নে বর্তমানে কমপক্ষে তিন থেকে চার কোটি টাকার প্রয়োজন। আর একটি ইটিপির জন্য কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে চার হাজার স্কয়ার ফুট ভূমিও প্রয়োজন। ফলে সাধারণ ট্যানারি শিল্পের উদ্যোক্তারা এই প্রতিবন্ধকতা দেখে এ শিল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে শুধু ট্যানারি নয়, এই শিল্পের সাথে জড়িত আড়তদারের সংখ্যাও দিন দিন কমেছে। চট্টগ্রামে কাঁচা চামড়ার আড়তদার সমিতির তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে চামড়ার আড়ত ছিল প্রায় ২০০টি। এর মধ্যে ১১২টি আড়তের মালিকরা এই সমিতির সদস্য। ১১২ জন আড়তদারের মধ্যে এখন টিকে রয়েছেন ২০-৩০ জন। এছাড়া ট্যানারি মালিকের কাছে বড় অঙ্কের পুঁজি আটকে থাকায় আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা পুঁজিহারা হয়ে পড়েছেন। ২০১৪-১৫ সালের প্রায় ২০ কোটি টাকা বকেয়া আটকে রয়েছে। ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা কিছু কিছু টাকা পরিশোধ করলেও বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া রয়ে গেছে। এতে পুঁজি হারিয়ে অনেক আড়তদার-ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
আরও জানা যায়, মৌসুমী ব্যবসায়ী, আড়তদার থেকে শুরু করে ট্যানারি মালিক-একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
চট্টগ্রামে পশু কোরবানি হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখের মতো। এখানে চামড়া সংরক্ষণ করা যেত প্রায় পাঁচ লাখের মতো। কিন্তু চামড়ার দাম কমে যাওয়া, চাহিদা না থাকা সহ এমন নানান সংকটে আড়তদার কমতে থাকায় চামড়া কিনে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে দাম না থাকায় মানুষ চামড়া ফেলে দিয়েছে।
সারা বিশ্বে বিখ্যাত ফরাসিদের ফ্রেঞ্চ কাফের চামড়ার পর মানের দিক থেকে বাংলাদেশের চামড়ার অবস্থান। গুছানো পরিকল্পনা নেওয়ার কারণে দেশের পোশাক শিল্প যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হয়ে উঠেছে, ঠিক তেমনি চামড়া শিল্প নিয়ে সুষ্ঠু ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে; এই শিল্প আগামী দিনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাময় একটি খাত হতে পারে।