আরাফার দিবসের তাৎপর্য

আরাফার দিন ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিনের তাৎপর্য অপরিসীম। এ দিন জোহরের সালাত আদায়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সমস্ত হাজি আরাফার মাঠে একত্র হন, আল্লাহর দরবারে দোয়া, মুনাজাত ও কান্নাকাটিতে লিপ্ত থাকেন। এ দিন আরাফার মাঠে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়, তা দেখে কোনো মানুষই তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না।

এ দিন সমস্ত হাজির রং এক, কথা এক ও মনোযোগ এক। তারা সবাই কেবল আল্লাহর দিকেই মনোযোগী। এক আল্লাহর প্রতি তাদের দৃষ্টি। এ দিনটি মুসলিম উম্মাহর মহান মিলন মেলা-ধনী-গরিব, রাজা-বাদশাহ, সবাই একই পোশাকে একই স্থানে একত্র হয়ে নিজের ভুল-ত্রুটি, অন্যায়, পাপাচার ইত্যাদির জন্য ক্ষমা চাইতে থাকেন।

আরাফার মাঠে হাজিদের মূল কাজ হলো আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেয়া ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। এ দিনের দোয়া ও মুনাজাতের গুরুত্ব অপরিসীম। জোহর ও আসরের সালাতকে জোহরের প্রথম ওয়াক্তের মধ্যে একত্রে আদায় করে নিবে। কোনো সুন্নত বা নফল সালাত আদায় না করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দোয়া মুনাজাত ও কান্না-কাটিতে ব্যস্ত থাকবেন। দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।

আরাফা শব্দের অর্থ হলো পরিচিতি। হজরত দ্বাহহাক (রহ.) বলেন, হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.)-কে বেহেশত থেকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। অবতরণের পর তারা একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একদিন দুজন আরাফাতের ময়দানে ৯ জিলহজ মিলিত হন। এ কারণে ওই স্থানের নাম হলো আরাফাত, আর ওই দিনের নাম হলো আরাফার দিন।

আরাফার দিনের ফজিলত সম্পর্কে বুখারি শরিফে বর্ণিত আছে, ইহুদিরা হজরত ওমর (রা.)-কে বলল, আপনারা এমন একটি আয়াত পড়ে থাকেন তা যদি আমাদের ওপর নাজিল হতো, তবে আমরা সেটিকে ঈদ হিসেবে উদ্‌যাপন করে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতাম। হজরত ওমর (রা). বললেন, এটি কখন ও কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে আর নাজিলের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) কোথায় ছিলেন তা আমি জানি। আল্লাহর শপথ! আমরা সবাই এ সময় আরাফাতে ছিলাম। এ দিন আমাদের জন্য দুটি ঈদ ছিল, প্রথমত সে দিন ছিল জুমাবার যাকে আমরা ঈদ হিসেবে উদ্‌যাপন করি, দ্বিতীয়ত- সে দিন ছিল ইয়াওমে আরাফা, যাকে হাদিসে ঈদের দিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে (বুখারি-৪২৫১)।

হাদিসে এসেছে-‘উত্তম দোয়া আরাফার দিবসের দোয়া এবং উত্তম কথা, যা আমি এবং আমার পূর্বের নবীগণ বলেছেন। ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোন শরিক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসাও তার, তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ [তিরমিযি: ৩৫৮৫]

অপর একটি হাদিসে এসেছে- আল্লাহতায়ালা আরাফার দিন এত বেশি বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, আর কোন দিন তিনি তার বান্দাদের জাহান্নাম থেকে এত বেশি মুক্তি দেন না। নিশ্চয়ই এ দিন আল্লাহ বান্দার নিকটবর্তী হন, তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করেন এবং বলেন, ওরা কী চায়? [মুসলিম: ১৩৪৮]

অপর হাদিসে এসেছে- আল্লাহ আসমানের অধিবাসীদের কাছে হাজিদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা আমার কাছে এসেছে এলোমেলো ও ধুলায় আবৃত অবস্থায়। [মুসনাদে আহমদ: ২/২২৪] এটি শুধু হাজিদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং যারা হজ করছেন না তাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যারা হাজি নয়, তারা যদি এ দিনে রোজা রাখে, তাহলে তা তাদের জন্য পূর্বের এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা। [মুসলিম: ১১৬৩]

আরাফার দিন মুসলিম উম্মাহর ওপর আল্লাহর দীন ও নেয়ামত পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিবস। তারিক ইবনে শিহাব থেকে বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে, ইহুদিরা ওমর (রা.)-কে বলল, আপনারা একটি আয়াত পড়েন, তা যদি আমাদের ওপর নাজিল হতো, তাহলে এ দিবসটিকে আমরা উৎসব করে পালন করতাম।

আরাফার দিনে আরাফাতের ময়দানে নবীজী ও সাহাবায়ে কেরাম যখন উকুফে আরাফা করছিলেন তখনই আল্লাহ তায়ালা নবীজী (সা.)-এর ওপর কোরআনুল কারিমের সর্বশেষ আয়াত নাজিল করে দ্বীনকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আর সেটি হলো সূরা মায়েদার ৩ নং আয়াত। এ আয়াত নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য চূড়ান্ত দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ এ আয়াত নাজিলের পর নবীজী (সা.) মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ২/২৪২)।

হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আরাফা দিবসের চেয়ে উত্তম কোনো দিন নেই। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীবাসীকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, তোমরা আমার ওইসব বান্দাদেরকে দেখো, যারা বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো চুল নিয়ে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আমার রহমতের আশায় ও শাস্তির ভয়ে আমার কাছে এসেছে। সুতরাং আরাফা দিবসের চেয়ে বেশি দোজখ থেকে মুক্তির আর কোনো দিন নেই। এই দিনে যে সংখ্যক লোক দোজখ থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে অন্য কোনো দিন করবে না (সহিহ ইবনে হিব্বান-৩৮৫৩)।

আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হাজিদের জন্য ফরজ। আরাফাতের ময়দানে হাজিরা হাজির হয়ে আল্লাহার রহমতের আশায় থাকেন। সমবেত সবাই ইবাদত-বন্দেগি ও গুনাহ মাফের জন্য কান্নাকাটি করে আল্লাহর জিকির, দোয়া, মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকেন। আর আল্লাহতায়ালাও বান্দাদের ইবাদত-বন্দেগি ও কান্নাকাটির বিনিময়ে তাদের ক্ষমা ও জান্নাত লাভের ঘোষণা দেন।

এমএইচএফ