দেশ বর্তমান ডেস্ক
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘হে নূতন’ গানে চির নতুনের মধ্যে দিয়ে নিজের পৃথিবীকে আগমনের শুভক্ষণকে ব্যক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/উদয়দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে/মোর চিত্তমাঝে/চির-নূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ।’
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিয়েছেন বিকাশের চূড়ান্ত সোপানে। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে রবীন্দ্রনাথের রয়েছে অসামান্য অবদান। নিজের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প ও অসংখ্য গানের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন তিনি। বিশ্বের দরবারে বাঙালিদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেও শিখিয়েছেন কবিগুরু। যার কারণে বাঙালির অস্তিত্বে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, সুরে ও বিচিত্র গানের বাণীতে, অসাধারণ সব দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিসংলগ্ন গভীর জীবনবাদী চিন্তা জাগানিয়া লেখায় এমনকি চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ চিরনবীন। প্রথম এশীয় হিসাবে ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এ সময় কবিগুরুর গান, কবিতা, সাহিত্য মানুষের মনে সাহস জোগায়, মনকে শান্ত করে। রবিঠাকুর বাঙালির মানসপটে সদাই বিরাজমান। বাঙালির জীবনের যত ভাবনা, বৈচিত্র্যে আছে, তার পুরোটাই লেখনী, সুর আর কাব্যে তুলে ধরেছেন কবিগুরু। তার সাহিত্যকর্ম, সঙ্গীত, জীবনদর্শন, মানবতা, ভাবনা-সবকিছুই সত্যিকারের বাঙালি হতে
অনুপ্রেরণা দেয়।
আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মজয়ন্তী। এ উপলক্ষে ছায়ানট, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিসহ দেশব্যাপী গান-নাটকের পাশাপাশি চিত্রকলা প্রদর্শনী ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কোথায় কী আয়োজন
ছায়ানটের রবীন্দ্র উৎসব ১৪৩০
রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে দুদিনের রবীন্দ্র উৎসব আয়োজন করেছে ছায়ানট। ২৫ ও ২৬ বৈশাখ (সোম ও মঙ্গলবার) প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান হচ্ছে। দুদিনই অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। ছায়ানট জানিয়েছে, ‘দুই দিনব্যাপী এ উৎসবে পরিবেশিত হবে একক ও সম্মেলক গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তি।’ অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পী ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল অংশ নেবেন। ছায়ানট মিলনায়তনে আয়োজিত এ উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত।
নাট্যদল প্রাঙ্গণেমো’র ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’
রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে নাটক ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’। কাল সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে নাটকটির বিশেষ প্রদর্শনী হবে। বিজ্ঞপ্তিতে প্রাঙ্গণেমোর জানিয়েছে, ‘প্রাঙ্গণেমোর-এর ২০তম প্রতিষ্ঠা দিবস এবং রবীন্দ্রনাথের ১৬২তম জন্মদিবস একসঙ্গে উদযাপন করা হবে মঙ্গলবার, সন্ধ্যা ৭টায়।’
বাংলা একাডেমিতে একক বক্তৃতা ও রবীন্দ্র পুরস্কার
দিনটি ঘিরে একক বক্তৃতা, রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৩ প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। আজ সকাল ১১টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান হবে। সেখানে স্বাগত বক্তৃতা করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। একক বক্তৃতায় আছেন রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন।
ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন বাংলা একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
শিল্পকলা একাডেমিতে ‘রঙ-তুলিতে বিশ্বকবি’
রবি ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আজ সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় নাট্যশালায় এ অনুষ্ঠান হবে। এছাড়া ‘রঙ-তুলিতে বিশ্বকবি’ শিরোনামে আর্ট ক্যাম্প হবে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি।
শাহজাদপুর কাছারিবাড়ি তিন দিনব্যাপী উৎসব
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে এখন সাজ সাজ রব। আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী জন্মজয়ন্তী উৎসব। আয়োজকরা বলছে, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী আনন্দঘন ও উৎসব মুখর করার পাশাপাশি অনুষ্ঠানে আগত দর্শনার্থীদের কথা মাথায় রেখে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একাডেমির চিত্রশালা গ্যালারিতে ৮-১৪ মে পর্যন্ত হবে রবীন্দ্রনাথের উপর অঙ্কিত চিত্রকর্মের প্রদর্শনী। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী সবার জন্য খোলা থাকছে। এছাড়া কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগ অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাদর্শ ও তার সৃষ্টিকর্ম শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে চিরদিন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে।
সোমবার (৮ মে) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে শেখ হাসিনা বলেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিনিধি। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি নির্দেশকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত স্রষ্টা। চিত্রকর, সমাজচিন্তক এবং মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবেও রয়েছে তার বিশ্বখ্যাতি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল প্রেরণার বিশেষ উৎস। শাশ্বত বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ- বেদনা অর্থাৎ সকল অনুভব বিশ্বস্ততার সঙ্গে উঠে এসেছে রবীন্দ্র সাহিত্যে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছাতেই রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি আমাদের জাতীয় সংগীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংকট উত্তরণে প্রেরণা নিতেন রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ববাদ, বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস মতাদর্শ, ইসলাম ধর্মের সুফিবাদ এবং বাংলার বাউলদের ভাববাদী চেতনার সমন্বয় সাধন করে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেন।
অহেতুক যুদ্ধ-সংঘাত, মৌলবাদের উত্থান, জাতীয়তা বোধের সংকীর্ণতা, শ্রেণিবৈষম্য হানাহানি- এসবের কারণে বর্তমান বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্র সাহিত্য আমাদের পাঠ করতে হবে প্রাত্যহিক জীবনবোধের আলোকে। তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে। তাঁর জমিদারির দরিদ্র প্রজাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, সমবায়নীতি ও কল্যাণবৃত্তি চালু করে তাদের ভিতর প্রণোদনা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর প্রবর্তিত সমবায় ব্যাংক, ক্ষুদ্র ঋণের প্রচলন পরবর্তীকালে গ্রামীণ উন্নয়নে একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের তিনি একান্ত আপনজন। শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে অবস্থানকালে এসব অঞ্চলের মাটি ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিলাইদহ ও পতিসর অঞ্চলেই তিনি রচনা করেছিলেন ‘ছিন্নপত্র’র সিংহভাগ এবং অসামান্য কিছু গান।’
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বকবির স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শিল্পীসত্তার সঙ্গে একাত্ম হয়েছে মানবিক সত্তাও। ফলে সাধারণ বাঙালির দুঃখ-বেদনার কথক হিসেবে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি তা পূর্ববঙ্গেরই সৃষ্টি। এসবের পাশাপাশি মানুষের প্রত্যক্ষ কল্যাণ কামনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ভেবেছেন।
তিনি বলেন, শিশুসহ নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেছেন শান্তি নিকেতন। সেইসঙ্গে তিনি পুথিগত শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার ক্ষেত্রে চিরকাল বিশ্বের জানালাকে খুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। জীবনের প্রতিটি সমস্যা-সংকট, আনন্দ-বেদনা এবং আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রসৃষ্টি আমাদের চেতনাকে আন্দোলিত করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।