গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা ধর্মঘট তথা হরতাল-অবরোধেল অধিকার রাখেন। হরতাল বা সাধারণ ধর্মঘট সে অর্থে একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। যেকোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন এমনকি ব্যক্তিবিশেষ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিতে পারেন এবং এটি তার অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। তবে হরতাল পালনে কোনো নাগরিক বাধ্য নয়। কোনো নাগরিক হরতালে যানবাহন চালাতে চাইলে, দোকানপাট খুলতে চাইলে তার সে অধিকার আছে এবং তাতে হস্তক্ষেপের অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। আবার, নাগরিকরা হরতাল-অবরোধে যানবাহন নিয়ে বের হলে সেটিতে অগ্নিসংযোগ করার অধিকারও কাউকে দেয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল এমনকি সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে যে হরতাল ডাকা হয়, তা পালন করতে দেশবাসীকে বাধ্য করা হয়।
হরতাল-অবরোধ একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পক্রিয়া হলেও কখনও কখনও সেটি গণতন্ত্রের কুফলও বটে। হরতাল-অবরোধে একটি দেশের পুরো শিল্প-বাণিজ্য ভেঙে পড়ে, ভেঙে যায় সাপ্লাই চেইন। আর সেটাই এখন হচ্ছে বাংলাদেশে। এর অন্যতম কারণ, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ।
দৈনিক দেশ বর্তমান এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপি-জামায়াত ও অঙ্গ সংগঠনের ডাকা অবরোধে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে অন্তত ১২টি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ২৮ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ দিনের হরতাল অবরোধে সারাদেশ ২৬৬টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল, যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবহনকারী কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনও।
হরতাল-অবরোধের নামে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে, দোকানপাটে হামলা চালিয়ে যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা ফ্যাসিবাদ চর্চার সঙ্গে তুলনীয়। এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকারের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ চর্চা অপরাধের শামিল এবং এ যুক্তিতে হরতাল নিষিদ্ধের কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে। দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হলো সুস্থ ও নিরুদ্বিগ্নভাবে জীবনযাপনের অধিকার। সে অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানে হরতাল ডাকার অধিকার বজায় রেখেও এর অপব্যবহার বন্ধের উপায় খোঁজা যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে হরতালকালে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির জন্য হরতাল আহ্বানকারীকে দায়ী এবং ক্ষতিপূরণ আদায়সহ কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে হরতালের ক্ষতির ভয়াবহতা কত, তা যে সরকার ও বিরোধী দল জানে না, তা নয়। এক দিনের হরতালে দেশের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এটি দৈনিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির একটা দিক। হরতালের প্রভাবের ক্ষতির দিকটি যোগ করলে অঙ্কটা আরও বড় হবে, তাতে সন্দেহ নেই। হরতালের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয় বলে চাহিদা ও সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। কাঁচা পণ্য নষ্ট হয়, শ্রমিকের আয় বন্ধ হয়। হরতালের ক্ষতি পোষাতে গিয়ে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, যার মাশুল গুণতে হয় ভোক্তাদের। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদান ব্যাহত হওয়ার ক্ষতি কত অঙ্কে হিসাব হবে? গাড়ি পুড়ছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর হচ্ছে-এসব তো আছেই। সরকারি অফিসের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা প্রভাব ফেলে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে।
হরতাল, অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান সব জায়গায় স্থবিরতা দেখা দেয়। আর্থিক লেনদেনে গতি থাকে না। ফলে অর্থনীতি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হরতালের কারণে অনেকেই কর্মস্থলে পৌঁছতে পারে না, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মস্থল। ক্ষতির পরিমাণটা যখন একত্রিত করে দেখা হয়, তখন সেই ক্ষতি রাষ্ট্রের ক্ষতি হিসেবেই দাঁড়ায়। ক্ষতির পরিমাণ যত বাড়বে, ততই বিপর্যয়ের দিকে এগোবে অর্থনীতি।