চট্টগ্রাম বন্দরে দেড়যুগ পর নতুন কন্টেইনার টার্মিনালের যাত্রা শুরু

দীর্ঘ দেড়যুগ পর চট্টগ্রাম বন্দরে যুক্ত হলো নতুন কন্টেইনার টার্মিনাল। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা উপকূলে নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালটি (পিসিটি) চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো টার্মিনাল যা বিদেশি কোম্পানি পরিচালনা করবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় সৌদি আরবের ‘রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল’ আগামী ২২ বছর এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। গতকাল সোমবার প্রথমবারের মতো এই টার্মিনালে একটি গিয়ারড কন্টেইনার ভ্যাসেল বার্থিং দেয়। একই সাথে তারা শুরু করে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর একটি ল্যান্ডলর্ড পোর্ট হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করল। ডেনমার্ক ভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের জাহাজ ভিড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হল এই টার্মিনালের পথচলা।

গতকাল সোমবার এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত ঘিরে চট্টগ্রাম বন্দরে ছিল নানা আয়োজন-আনুষ্ঠানিকতা। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলসহ বন্দর, আরএসজিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই উদ্যোগ। নবনির্মিত টার্মিনালটি বছরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে ৫ লাখ টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের)।

জানা যায়, সৌদি আরবের জেদ্দাভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের (আরএসজিটি) সঙ্গে মাস ছয়েক আগে চুক্তি হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করে রেড সি গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড গতকাল সোমবার থেকে কাজ শুরু করেছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর একটি ল্যান্ডলর্ড পোর্ট হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘মায়ের্কস দাবাও’ নামের একটি কন্টেইনার ভ্যাসেল আজ (গতকাল) বিকেলে জেটিতে ভিড়ানো হয়। খালাস করা হয় আমদানি পণ্যবোঝাই কন্টেইনার। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও। এ উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনালে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী জাহাজটি গত শনিবার দুপুরে মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং হয়ে চট্টগ্রাম এসেছে। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১৮৫ দশমিক ৯৯ মিটার ও ড্রাফট (পানির নিচে থাকা অংশ) ৯ মিটার।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল জানান, বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা উপকূলে নির্মিত হয়েছে পিসিটি। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় সৌদি আরবের আরএসজিটি এ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তারা শর্ত সাপেক্ষে আগামী ২২ বছর টার্মিনাল পরিচালনা করবে। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর আরএসজিটির সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি হয়। এই টার্মিনালে এখন কেবলমাত্র ক্রেনযুক্ত জাহাজই বার্থিং দেওয়া হবে। গ্যান্ট্রি ক্রেন এসে গেলে সব ধরনের জাহাজ বার্থিং দেওয়া হবে।

তিনি আরও জানান, সব সরঞ্জাম সংগ্রহ করে পিসিটি পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে আরও এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব ইক্যুপমেন্ট সংগ্রহ করবে দায়িত্ব পাওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চার্জ পাবে।

পিসিটি’তে তিনটি কন্টেইনার ও একটি তেল খালাসের (ডলফিন) জেটি রয়েছে। এগুলোতে একসঙ্গে চারটি জাহাজ ভিড়ানো যাবে। কন্টেইনার জেটির দু’টিতে গ্যান্ট্রি ক্রেন থাকবে। যেখানে ভিড়তে পারবে গিয়ারলেস (ক্রেনবিহীন) জাহাজ এবং অপরটিতে গিয়ার্ড (ক্রেনযুক্ত) জাহাজ। পিসিটির চারটি জেটিতে একসঙ্গে চারটি জাহাজ বার্থিং নিয়ে পণ্য ওঠানামা করার সুযোগ রয়েছে। ফলে বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজের চাপ কমে যাবে। পণ্য খালাসের অপেক্ষায় জাহাজকে দীর্ঘদিন বসে থাকতে হবে না।

সূত্রমতে, এখানে সমুদ্রের গভীরতা বেশি থাকায় ভিড়ানো যাবে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের জাহাজ। ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়তে পারবে অনায়াসে। এর আগে ২০০ মিটার লম্বা একটি জাহাজ পরীক্ষামূলকভাবে জেটিতে আনা হয়েছিল। পিসিটি’র মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর পর পেতে চলেছে নতুন কন্টেইনার টার্মিনাল। এর আগে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মিত হয়েছিল ২০০৬ সালে।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সময় এসেছে বিদেশি অপারেটদের সঙ্গে দেশি অপারেটরদের পণ্য ওঠানামা তুলনা করার। পিসিটি চালু হলে সেই তুলনা করা যাবে। এতে জানা যাবে দেশি অপারেটরদের দক্ষতা কতটা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বন্দরের মেরিন বিভাগের এক পাইলট জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে এনসিটি, সিসিটির নদী পথের দূরত্ব ১১ নটিক্যাল মাইল। কিন্তু পিসিটির দূরত্ব ৮ নটিক্যাল মাইল। ফলে তিন নটিক্যাল মাইল সময় সাশ্রয় হবে। আর কিছুটা কম জোয়ারের পানিতে পিসিটিতে জাহাজ প্রবেশের সুযোগ থাকবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, পণ্য খালাসে সময় ও অর্থ কতটা সাশ্রয় হচ্ছে এই দু’টি বিষয় আমরা নজরে রাখব। কারণ বিদেশি অপারেটর চালুর একটাই লক্ষ্য, বন্দর সেবাকে আর্ন্তজাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করা। সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে আমরা আর্ন্তজাতিক রপ্তানি পণ্য বাজারেও এগিয়ে থাকব।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বড় জাহাজগুলো কন্টেইনার নিয়ে ভিড়ার মাধ্যমে আমাদের আমদানি রপ্তানির চাহিদা পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। মায়ের্সক লাইনের মত কোম্পানিগুলো যখন এগিয়ে আসছে, তার মানে নিঃসন্দেহে ভালো কিছুই হবে।