পূর্বাচলে খাল খনন প্রকল্পে অনিয়ম

ক্ষতিপূরণ দাবি সিন্ডিকেটের ০ প্রকৃত মালিকের জমি জবর দখল ০ ঢাকা এলএ শাখার যোগসাজস

‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের দুইপাশে (কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত) ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্প’। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এই প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন দুই ভাই মো: আল আমীন এবং কায়কোবাদ রহমান। তাদের দাবি, তাদের জমি জবর দখল করা হয়েছে, প্রকৃত মালিক হওয়া স্বত্ত্বেও তাদের জমিতে গড়ে ওঠা পানি শোধনাগার ও তৈরি পোশাক কারখানা থেকে পাওয়া অর্থ তাদের দেয়া হচ্ছে না। ঢাকা এলএ শাখার সহযোগিতায় ভাড়াটিয়া সেজে অর্থ তুলছে একটি অসাধু চক্র। চক্রটি অধিগ্রহণ বাবদ ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের বঞ্চিত করে ভুয়া দাবিদারদের অনুকূলে অর্থ পরিশোধ দেখিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে।

রেকর্ডপত্র ঘেটে দেখা যায়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের দুইপাশে (কুড়িল থেকে বালুনদীপর্যন্ত) ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন  ও উন্নয়ন শীর্ষক’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এটি বাস্তবায়নে স্থানীয়দের শতশত বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এতে  ভিটামাটি হারিয়ে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ১২শ’ পরিবার। এরমধ্যে ৫৫০টি পরিবারকে এরইমধ্যে ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ৬শ’ পরিবারের জমি নিয়ে রয়েছে বিরোধ। নানা অজুজাতে কারও কারও ক্ষতিপূরণ আটকে রাখা হয়েছে। ৪ ধারায় নোটিশ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে অধিগ্রহণ। এছাড়া ৫০টি পরিবার ক্ষতিপূরণ লাভের আবেদনও করেনি।

এ প্রকল্পে পৈত্রিকভিটার ভূমি হারানো একজন ১১০, খিলক্ষেত, ইশাপুরা রোড, বরুয়া বাগানবাড়ি নিবাসী মো: আতাউর রহমান। তিনি ইন্তেকাল করায় এখন সম্পত্তির বৈধ মালিকানায় রয়েছেন তার দুইপুত্র মো: আল আমীন এবং কায়কোবাদ রহমান। একই  দাগের ৪ বিঘা পৈত্রিক সম্পত্তির একটি অংশ জুড়ে শেড তুলে পানি পরিশোধন প্লান্ট ও তৈরি পোশাক কারখানা চালাচ্ছিলেন তারা। এ অবস্থায় এ সম্পত্তির অন্তত: ২২ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়ে। খতিয়ান নং-১৪২ (রেকর্ডীয়), দাগ নং-১১২৮৯ অংশ, জমির শ্রেণি-পুকুর, অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমির পরিমাণ-০.২২৯৯ একর।

অধিগ্রহণে ৪ ধারার নোটিশ রিসিভ করেছেন জমির প্রকৃত মালিক। অথচ অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ তুলে নিচ্ছেন ভূমি মালিকের ভাড়াটিয়া। আর  এই অর্থ ভাড়াটিয়ার হাতে তুলে দিতেই মরিয়া হয়ে উঠেছেন অধিগ্রহণ শাখা। ভাড়াটিয়াকে নোটিশ দেয়া হচ্ছে। তার সঙ্গে আপস-মীমাংসার নামে ডাকা হচ্ছে বারবার। তার কথিত ‘ক্ষতিপূরণ দাবি’কে শক্তিশালী  ভিত দিতে পরিকল্পিতভাবে ইস্যু করা হচ্ছে চিঠি।

জমিগুলো অধিগ্রহণের আওতায় পড়তে যাচ্ছে- আগেই জানা ছিলো ঢাকা জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণের (এলএ) শাখার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের। এ প্রকল্পে ঢাকার এল.এ. শাখার এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিশানায় পরিণত হন বরুয়ার আলামীন ও কায়কোবাদ ভাতৃদ্বয়। প্রায় দুই দশকআগে ঘোষিত হয় এ প্রকল্প। বাস্তবায়নকাল ঘনিয়ে আসতেই ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর সম্ভাব্য অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তিতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ‘ভাড়াটিয়া’ হিসেবে বসানো হয় আব্দুল্লাহ আল মাসুম আনসারী নামক এক ব্যক্তিকে। তাকে দিয়ে আলামীন-কায়কোবাদের সঙ্গে রেজিস্ট্রি বিহীন একটি ভাড়ার চুক্তিপত্র সম্পাদন করান।

চুক্তিপত্রে উক্ত ভাড়াটিয়া নিজেকে ‘গোল্ডেন ওয়ান প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি:’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলে উল্লেখ করেন। ঠিকানা-৯৩/১, রূপায়ণ গার্ডেন রোড-৮, ব্লক-সি, নিকেতন, গুলশান-১, ঢাকা। নবায়নের শর্তে ওই শেড সমেত জমি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে ভাড়া পরিশোধের চুক্তি হয় মাসুম আনসারীর সঙ্গে। একপর্যায়ে স্থান সংকুলান না হওয়ার কথা বলে তিনি আল আমীন ও কায়কোবাদের কাছ থেকে  শেডসহ আরও জমি ভাড়া নেন। ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে ২০২০ সালে ২৮ মাসের জন্য সর্বশেষ ভাড়া নেন আনসারী।

পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর এল এ কেস (নং-০১,০১.০৫/২০২১-২০২২)র প্রেক্ষিতে ডিসি অফিস থেকে ৪ ধারায় নোটিশ আসে মো: আতাউর রহমানের নামে। তিনি ইন্তেকাল করায় নোটিশ গ্রহণ করেন তারপুত্র আলামীন ও কায়কোবাদ রহমান। এ প্রেক্ষিতে তারা মাসুম আনসারীকে ভাড়াকৃত জমি ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্ত আনসারী বিষয়টি দুই ভাইয়ের সঙ্গে মিটমাট না করে ক্ষতিপূরণ চেয়ে সরাসরি আবেদন করেন ঢাকা জেলার এল.এ.শাখায়। ওই শাখা তার আবেদনটি সুপারসনিক গতিতে আমলে নিয়ে শুনানির জন্য চিঠি দেয়। এ কাজে সহযোগিতা করেন আনসারীর ঘনিষ্টবন্ধু অধিগ্রহণ-১ শাখার কানুনগো মোহাম্মদ খলিলুর রহমান। তিনিই আবেদনটি পরবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য তৈরি করে দেন। আনসারীর আবেদন গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রথমত: তার ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হওয়ার দাবিকে এলএশাখার স্বীকৃতি আদায় করে দেন খলিল।

এ ধারাবাহিতায় ঢাকার ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ইরতিজা হাসান গত ২৯ আগস্ট আব্দুল্লাহ আল মাসুম আনসারীকে একটি চিঠি (স্মারক নং-০৫.৪১.২৬০০.০৩৩.৫২.০০৪.১৭৪) দেন। তাতে বলা হয়, রাজউক কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয়পার্শ্বে (কুড়িল হতে বালুনদী পর্যন্ত) ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়নশীর্ষক’ প্রকল্পের আওতাধীন এলএ কেস (নং-০১,০১.০৫/২০২১-২০২২)র আওতাধীন বিধায় উক্ত ফ্যাক্টরির মেশিনারিজ ও অবকাঠামো স্থানান্তরের কোনো সুযোগ নেই। ক্ষতিগ্রস্ত আল আমীনের অভিযোগ, এ ফ্যাক্টরির পুরো অবকাঠামো তাদের নিজস্ব। এখানে মাসুম আনসারীর  কোনো অবকাঠামো নেই। সুতরাং তার জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। তারা স্থাপনায় টানা নিজস্ব বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিন্তু মাসুম আনসারী পুলিশ প্রশাসনকে সাথে নিয়ে পুনরায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়ার চেষ্টা করেন। যদিও বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান এবং বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্ব বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের।

ইরতিজা হাসানের চিঠিকে ভিত্তিতে তিনি নিজেকে অধিগ্রহণের ক্ষতিগ্রস্ত বলে দাবি ও প্রচার করেন। এক পর্যায়ে এ চিঠির নির্দেশনা লঙ্ঘন করে মাসুম আনসারী রাতের আঁধারে ১৮টি ট্রাকে করে মাল সামানা সরিয়ে নেন। তবে জমির দখল ছাড়ছেন না। ডিসি অফিসের এলএ. শাখার সহায়তায় চাইছেন ক্ষতিপূরণের অর্থে ভাগ বসাতে। এলএ শাখা সূত্র জানায়, মাসুম আনসারীকে আন-অফিসিয়ালি সহায়তা, শক্তি ও ভরসা যোগাচ্ছেন তার ঘনিষ্ট বন্ধু অধিগ্রহণ শাখা-১ এর কানুনগো (ব্যারিস্টার) মোহাম্মদ খলিলুর রহমান। ক্ষতিপূরণের অর্থে ভাগ বসাতে মাসুম আনসারীকে ব্যবহার করছে তার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট। শক্তিধর খলিলুর রহমান এতোটাই প্রভাবশালী যে, কোনো জেলা প্রশাসকই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সাহস করেন না। তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়, প্রভাবশালী মহল এবং উচ্চ লবি রক্ষা করে চলেন বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে মোহাম্মদ খলিলুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দেশ বর্তমান প্রতিবেদককে বিলেন, কানুনগো হিসেবে অধিগ্রহণযোগ্য সম্পত্তির তফসিল উল্লেখ করে রেকর্ড মোতাবেক সম্পত্তির মালিক মো: আতাউর রহমানকে ধারা ৪ এর (১) নং উপ-ধারা) অনুযায়ী নোটিশ করা হয়েছে। এসব জমির বাস্তব অবস্থা, স্থাপনা, অবকাঠামো ইত্যাদির ভিডিও/সরেজমিন তদন্ত করে মালিকানা/দখল ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত যৌথ তদন্ত সম্পন্ন করেন  রুকনুজ্জামান। ডিসি অফিসের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারি বিধিসম্মতভাবেই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমার বদলী হয়ে গেছে বরিশালে, আমি আর এ বিষয়ে কিছু জানি না।

সম্পত্তি দখলে রাখা এবং ক্ষতিপূরণ দাবির বিষয়ে যোগাযোগ করলে আব্দুল্লাহ আল মাসুম আনসারী বলেন, ২০১৫ সালে আমি খালি জমি ভাড়া নিয়েছি। এরপর স্থপনা করেছি। আমি স্থাপনার ক্ষতিপূরণ চেয়েছি মাত্র।  এদিকে জমির মালিক বা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তর ক্ষতিপূরণের টাকা ভাড়াটিয়ার হাতে তুলে দেয়ার প্রচেষ্টার সঙ্গে খলিল সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা প্রশাসক মো: আনিসুর রহমান বলেন, এরই মধ্যে আমরা খলিলকে বদলি করেছি।