হঠাৎ করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। সন্ধান মিলছে নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের । আইনশৃংখলা বাহিনীর পাতা ফাঁদে ধরা পড়ছে নতুন নতুন ও পুরাতন জঙ্গি নেতা। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য। হদিস মিলছে কয়েকমাস, বছর আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হওয়া স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের।
জানা গেছে, নিষিদ্ধ জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের পুরাতন নেতারা নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের জন্ম দিচ্ছে। নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানসহ বিভিন্ন গহীন পাহাড়ে। সেখানকার সন্ত্রাসি গোষ্ঠী কেএনএফের সামরিক শাখায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ শিবিরে সাঁড়াশী অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেএনএফ’র অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। এসব অভিযানে সেনাসদস্যদের মর্মান্তিকভাবে নিহত হতে হচ্ছে।
সোমবার (৫ জুন) রাতে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় তল্লাশি চৌকি বসিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবসহ (৩৪) তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেপ্তারকৃত অন্য দুজন হলেন জাকারিয়া হোসাইন (২৯), আহাদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে সিফাত ওরফে মামিদ (২২)। তাঁদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের মধ্যে মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব ২০১৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরে দেশে ফিরে জামাতুল আনসারে যোগ দেন। সংগঠনটির অর্থ শাখার প্রধান হন। অর্থ সংগ্রহ এবং বিতরণ তাঁর হাত দিয়েই হতো।
র্যাব বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান এবং তৎপরতার কারণে কৌশল পরিবর্তন করেছে সংগঠনটি। এখন থেকে তারা টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে অবস্থান করে সংগঠন পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে। নিজেদের আত্মগোপন করতেই তারা এই কৌশল নিয়েছে।
গ্রেপ্তার তিনজনসহ কয়েকজন গাজীপুর হয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরের দিকে যাচ্ছিলেন, এমন সংবাদের ভিত্তিতেই চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল।
তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানিয়েছেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) সঙ্গে চুক্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে আশ্রয়, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাশাপাশি জামাতুল আনসারকে অস্ত্র ও ‘রসদ’ সরবরাহ করত কেএনএফ।
খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের ফলে পাহাড়কে নিরাপদ মনে না করায় আমিরের নির্দেশে জঙ্গিরা পাহাড় থেকে পালিয়ে সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে যায়। এরপর আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এখন তারা সংগঠনের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদের নির্দেশে টাঙ্গাইলের মধুপুরের ঘন জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে সংগঠন পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে।
র্যাব সূত্র জানায়, গত বছরের (২০২২) ২৩ আগস্ট কুমিল্লা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আট তরুণ নিখোঁজের সূত্র ধরে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা এবং অন্যান্য ব্যাটালিয়ন গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। একপর্যায়ে নতুন এই জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের খোঁজ পাওয়া যায়।
এই সংগঠনের ৫৫ জন সদস্য কেএনএফের ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে বলে জানা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে গত বছরের ৩ অক্টোবর থেকে র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। সেই অভিযান এখনো চলছে।
জানা যায়, কেএনএফের সদস্যরা মূলত বম জাতিগোষ্ঠীর। পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ আস্তানা গড়ে তোলার জন্য কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগ করে জামাতুল আনসার। অর্থের বিনিময়ে জামাতুল আনসার ২০২১ সালে কেএনএফের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রশিক্ষণ এবং পাহাড়ে অবস্থান করে নিজেদের আড়াল করতে জামাতুল আনসার এই কৌশল নিয়েছিল।
সিলেট থেকে গ্রেপ্তার হওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদ্ল্লুাহ মায়মুন ওরফে মুমিনের (৩৪) সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান ও বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে দাবি করেছে র্যাব।
র্যাবের সিলেট সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এর আগে আজ সকালে সিলেটের বিমানবন্দর বড়শালা এলাকার একটি বাড়ি থেকে আবদুল্লাহ মায়মুনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
আবদুল্লাহ মায়মুন সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, আবদুল্লাহ মায়মুন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সংগঠনটির সিলেট বিভাগীয় মসুল বা প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। সংগঠনটির শীর্ষ নেতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে আবদুল্লাহ মায়মুনের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি জিয়া নিয়মিত আবদুল্লাহ মায়মুনের বাসায় যাতায়াত করতেন। ২০১৯ সালে মায়মুন বগুড়ায় সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করেন।
পরে ২০২০ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। পরে জামিন বাতিল হলেও আবদুল্লাহ মায়মুন আত্মগোপনে চলে যান। মূলত আবদুল্লাহ মায়মুন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে নতুন সংগঠনটির যোগাযোগ করিয়ে সেতুবন্ধন করে দিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ মায়মুনের মাধ্যমেই নতুন সংগঠনকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেয় আনসার আল ইসলাম।
সিলেট থেকে গ্রেপ্তার অন্য তিন ব্যক্তি হলেন ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের মো. আবু জাফর ওরফে জাফর ওরফে তাহান (৪০), চাঁদপুর মতলব উত্তরের মো. আক্তার কাজী ওরফে সাইদ ওরফে আইজল (৩৮) ও গোপালগঞ্জ মুকসেদপুরের সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা (৩২)।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব বলে, নতুন জঙ্গি সংগঠনটির গড়ে তোলার পেছনের কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় পুরোনো সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়া। সাঁড়াশী অভিযানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল পুরোনো জঙ্গি সংগঠনগুলো। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ থেকে কয়েকজন বের হয়ে নতুন সংগঠনটি গড়ে তোলেন। সংগঠনের সদস্যদের বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনপ্রণেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ ধারণা রয়েছে। সদস্য সংগ্রহ করে জঙ্গিরা সংগঠিত হয়ে চট্টগ্রামে পাহাড়ে আবাসিকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলো।
মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব জামাতুল আনসারের অন্যতম শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান। তিনি ২০১৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকার সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন। এর পাশাপাশি গার্মেন্টস পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। শুরু থেকেই তিনি সংগঠনের অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহের দায়িত্বে আছেন। দেশ ও দেশের বাইরে থাকা সংগঠনের অর্থ তাঁর কাছেই থাকত।
জাকারিয়া ২০০৮ সালে স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে হিফজ শেষ করে ফরিদপুরে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০২১ সালে অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেনের মাধ্যমে তিনি সংগঠনে যোগ দেন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাওয়ার কথা বলে তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। ২০২২ সালের প্রথম দিকে তিনি রাকিবের মাধ্যমে বান্দরবানের থানচি ও বাকলাইপাড়া হয়ে কেএনএফের প্রশক্ষিণ ক্যাম্পে আসেন। তিনি পাহাড়ে এসে অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন।
আহাদুল কুমিল্লার একটি কলেজে অনার্স ৪র্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সংগঠনের আমির মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমির মাহমুদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সংগঠনে যোগ দেন। তিনি ২০২১ সালের শুরুতে ঘর ছাড়েন।
পরে তিনি পাহাড়ে কেএনএফের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর পর জাকারিয়া এবং আহাদুল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে সমতলে এসে আত্মগোপন করেন।
এদিকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়িত জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম অর্থ সরবরাহকারীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র্যাব। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
র্যাব বলছে, গ্রেপ্তার ও অর্থ সরবরাহকারীর নাম শাহ মো. ঘাবিবুল্লাহ হাবিব (৩২)। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া তিনজন রয়েছেন। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা হলেন নেয়ামত উল্লাহ (৪৩), মো. হোসাইন (২২), রাকিব হাসনাত (২৮) ও মো. সাইফুল ইসলাম।
র্যাব আরও বলেছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে উগ্রবাদী পাঁচটি পুস্তিকা, প্রায় ৩০০ লিফলেট এবং পাঁচটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা কীভাবে অন্যদের জঙ্গি সংগঠনে উদ্বুদ্ধ করতেন, তা জানিয়েছে র্যাব।
কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া আট তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামের এক ব্যক্তি রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
র্যাব বলছে, শারতাজের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৬ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি, তত্ত¡াবধানকারী, আশ্রয় প্রদান কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তিনজন, নিরুদ্দেশ চার তরুণসহ মোট সাতজনকে র্যাব গ্রেপ্তার করে । গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা উগ্রবাদী সংগঠনটির সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব আরও বলছে, বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণের সংখ্যা ৫০ এর বেশি। তারা প্রায় দেড় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ ছিলেন।