ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ভেনিস নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে। ভেনিস এখন সাগরে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বলা হচ্ছে, চলতি একুশ শতকে হয়তো সাগরে তলিয়ে যাবে শহরটি। এরইমধ্যে অনেক ভবন ডুবতে শুরু করেছে; অনেক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। শহরটি দেখতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা। তবে সেখানে বাসিন্দার সংখ্যা ক্রমেই কমছে।
সুদৃশ্য অট্টালিকা। পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে নৌকা। বাসিন্দারা এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাচ্ছেন নৌকায়। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে ভবনের দেয়ালে। চারদিকে পানি। মাঝেমধ্যে ভবন ও বসতি। দেখলে মনে হয়, অগণিত বাড়িঘর ভেসে আছে সাগরের স্ফটিক জলে! ছোট-বড় নালার পাশ ঘেঁষে সবুজ উদ্যানও দেখা যায়। পানির ওপরে মাছ শিকারি সাদা পাখির ওড়াউড়ি। কী দারুণ দৃশ্য!
ইতালির উত্তরাঞ্চলে আদ্রিয়াতিক সাগরে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহর ভেনিস। ১২০টি দ্বীপ নিয়ে ঐতিহ্যবাহী এ শহর বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এর ভেতরে ১৭৭টি নালায় সাগরের স্ফটিক জলের প্রবাহ। নালাগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত। হেঁটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে রয়েছে ৩৯১টি সেতু। তবুও বিচ্ছিন্ন অনেক দ্বীপে নৌকা ছাড়া পৌঁছানো যায় না। ডিঙি নৌকার পাশাপাশি আছে ইঞ্জিনের নৌকাও। ভেনিসের সুদৃশ্য ভবনগুলোর মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ‘গোল্ডেন অ্যাঞ্জেল স্ট্যাচু’ ভেনিসের শত শত বছরের ইতিহাস ও গৌরবের কথা বলে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মেরু অঞ্চলে বরফ গলা শুরু হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের এ উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। এর প্রভাবে নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করছে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভেনিসে ১০০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। তখন জোয়ার স্বাভাবিকের চেয়ে ১৮৭ সেন্টিমিটার বা ৬ দশমিক ১ ফুট উঁচুতে ওঠে। তলিয়ে যায় শহরের ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা। ঘোষণা করা হয় জরুরি অবস্থা। ভেনিসের মেয়র লুইগি ব্রুগানেরো জানান, ওই বন্যার ক্ষতি পোষাতে খরচ করতে হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার।
ভেনিসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয় ১৯৬৬ সালে। তখন জোয়ারের উচ্চতা ছিল ১৯৪ সেন্টিমিটার বা ৬ দশমিক ৪ ফুট। এতে শহরের এক-তৃতীয়াংশ দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পানির উচ্চতা বাড়ার হিসাবনিকাশ শুরু হয় ১৯২৩ সালে।
ভেনিস সব সময়ই সাগরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ২০২১ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের আগে বায়ুমণ্ডলে যে তাপমাত্রা ছিল, বর্তমানে তা থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়লে একুশ শতকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩২ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে। চরম খারাপ হবে যদি চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ে। এতে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে, যার অর্থ- ভেনিসের অধিকাংশ এলাকা সাগরে বিলীন হয়ে যাবে।
ম্যানচেস্টার স্কুল অব আর্কিটেকচারের স্থাপত্যবিদ স্যালি স্টোন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এ কারণে সাগর তীরে গড়ে ওঠা যে কোনো শহরই ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে।
কেবল ভেনিসই নয়, বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি শহর একই ঝুঁকিতে আছে। সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকলে এগুলো অনিবার্যভাবে তলিয়ে যাবে। এ রকমই আরেকটি শহর জাকার্তা। নিম্নাঞ্চলে থাকার কারণে এটি আর ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী থাকছে না। ভবিষ্যতে দেশটির রাজধানী হবে নুসানতারা। শহরটি নির্মাণাধীন।