
ওরা আমাদেরই সন্তান। আমাদের সকল স্বপ্ন তাদেরকে ঘিরেই। তাদের সকল আবদার অধিকার আমাদের কাছেই। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় -স্বজন, প্রতিবেশি সকলের কাছে তারা একটু নিরাপত্তা চায়,নিরাপদে বাঁচতে চায়, আদর-স্নেহ চায়। এইসব পাওয়ার শতভাগ অধিকার তাদের আছে। তারা আমাদের অটিজম শিশু। সকল ধর্ম বর্ণের মা-বাবার আকাঙ্খা থাকে সন্তান সুস্থ,সবল, বুদ্ধিদীপ্ত হোক।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মিল অনেক সময় দেখা যায় না । সাধারণ সুস্থ শিশুদের পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অসাধারণ শিশুদেরও জন্ম হয়। ডাউন সিন্ড্রোম, অটিজম, থালাসেমিয়া, সেরিব্রাল পলসি, মানসিক প্রতিবন্ধিকতা,এপিলেনসি আক্রান্ত শিশুরা সচেতনতার অভাবে, চিকিৎসার অভাবে অবহেলায় জীবন অতিবাহিত করেন । আমাদের সচেতন হওয়া দরকার, যাতে আমাদের আপনজনের মতো এইসব শিশুরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না হয়। অসাধারণ শিশুদের নিয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে ভাবনা চলছে। তাদের জন্যই আজ আমার এলেখা।
গবেষক পন্ডিতরা আজও পরিষ্কার কোনো তথ্য দিতে পারেননি কেন পৃথিবীতে অটিজম শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। দু-দশক আগেও যেখানে অটিজম শিশু খুঁজে পাওয়া যেতো না,. সেখানে বর্তমানে ৮/১০ জন মানুষের সাথে কথা বললেই ২/১ জন অটিজম শিশুর কথা ওঠে আসে। কিন্তু শিশুটি অটিজম শিশু না-ও হতে পারে। শিশু কথা বলেনা,কারো সাথে মিশতে পারে না, এর অর্থ এই নয় যে, শিশুটি অটিজম। অন্য কোনো মানসিক সমস্যার কারণেও এমনটা হতে পারে। প্রয়োজন যথাযথ রোগ নির্ণয়, তারপর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
বুদ্ধিবৃত্তিক ও আচরণগত সীমাবদ্ধতার বিশেষ কিছু লক্ষণের সামষ্টিক নাম অটিজম। এধরণের শিশুরা অন্য মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও চাহিদাকে বুঝতে পারেনা । ব্যক্তির এরূপ আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সর্বপ্রথম পল ইউজেন ব্লুলার নামের একজন চিকিৎসক ১৯১২ সালে এই সমস্যার নামকরণ করেন ‘ অটিজম ‘। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় – ‘আত্মমগ্ন ব্যক্তি ‘। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সর্বদা নিজেকে নিয়েই মগ্ন থাকতে পছন্দ করে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই সে অন্যের সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে। অনেকের ভাষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অপরিপূর্ণতা থেকে যায়,ফলে তাদের পক্ষে অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করা ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিই কোনো না কোনো পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে থাকে। যেমন- কেউ রেগে গেলে ক্রমাগত দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকতে থাকে, কেউবা একই কাজ প্রতিদিন একই ধারা বজায় রেখে করে, তাদের প্রাত্যহিক কার্য সূচিতে সামান্যতম পরিবর্তন হলেও অস্থির হয়ে ওঠে অর্থাৎ, তারা কোনো পরিবর্তন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না।
কিছু অটিজম- আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশু কোনো বিশেষ শব্দ,গন্ধ,স্পর্শ ও দৃশ্যের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। কোনো ব্যক্তির এরূপ আচরণ হঠাৎ করে দেখা দেয়না বরং তা অতি শৈশবকাল বিশেষ করে দুই থেকে তিন বছর বয়সে প্রকাশিত হয়ে আজীবন চলতে থাকে। তবে ব্যক্তির এ অস্বাভাবিক আচরণ নিয়মিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দ্বারা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা বা উন্নতি ঘটানো যেতে পারে।
কিন্তু দেশে অটিজম শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য গুটি কয়েক বিশেষ স্কুল ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের জন্য যে-সব স্কুল রয়েছে তার সবগুলোই শহরে অবস্থিত । এইসব প্রতিষ্ঠানে যে শিক্ষক রয়েছেন তাঁদের অনেকেরই অটিজম শিশুদের পাঠদানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন তাদের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে গিয়ে প্রথম অটিজম শিশু দেখে। ফলে এবিষয়ে তারা যে জ্ঞান অর্জন করেন তার পুরোটাই কর্মকালীন প্রশিক্ষণ যা সমস্যা নিরাময়ের জন্য তেমন উপযোগী নয়, বরং অনেক সময় নিজেদের অজান্তেই ওইসব শিশুদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেন। তাই অটিজম শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দেশে-বিদেশে মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রদান অতীব জরুরি।
অটিজম বিষয়টি সহজভাবে বোঝার জন্য এবং জনগণকে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তন্মধ্যে পূর্ণাঙ্গ অটিজম একাডেমি প্রতিষ্ঠা, অটিজম বিষয়ক প্রশিক্ষণ মড্যুল তৈরি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপকরণ প্রস্তুত, সরবরাহ এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ, এনসিটিবি কর্তৃক নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষাক্রমে অটিজম বিষয়টি অন্তর্ভুক্তকরণ। বছরব্যাপী শিক্ষক- অভিভাবকদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা। সরকারের এপদক্ষেপগুলো সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
অবহেলা অনাদর নয়, আমরা ভালোবাসাময় করে তুলবো অটিজম শিশুর জীবন। আমাদের সন্তানদের যোগ্য করে তুলবো মূলধারার শিক্ষার্থীদের সাথে যেন তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। আর দেরি নয়, এখনই সময় পদক্ষেপ নেয়ার।
লেখক : শিক্ষক, শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।