মিথ্যা তথ্য দিয়ে আ.লীগের ক্ষমতার দাপটে নিকাহ্ রেজিস্ট্রার ওলামা লীগ নেতা মোস্তফা এখনো বহাল তবিয়তে

সরকারকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিকাহ্ রেজিস্ট্রার পদ বাগিয়ে নেয়া ওলামা লীগের গাজীপুর জেলার সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক মোস্তফা কামাল এখনো বহাল তবিয়তে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আইন মন্ত্রণালয় ও জেলা রেজিস্ট্রার তদন্ত করে প্রমাণিত হবার পর শাস্তির ব্যবস্থা করলেও তৎকালীন আওয়ামীলীগের এমপিদের ক্ষমতার অপব্যবহার আর দাপটের কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মোস্তফা কামাল ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ৫ থেকে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ্ রেজিস্ট্রার হলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিয়োগের সময় এসকল ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। বরং তিনি ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শিরির চালা এলাকার জন্মসূত্রে বাসিন্দা। তবে তিনি যখন নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিয়োগ পান সেসময় আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে তথ্য দিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা,২০০৯ এর ৮ বিধি অনুযায়ী তা অসদাচরণ।

মোস্তফা কামাল মিথ্যা বাসিন্দাগত তথ্য দিয়ে অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার হয়েছেন এমন অভিযোগ এনে ২১ জানুয়ারি ২০১৮ সালে এলাকাবাসীর পক্ষে আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর অভিযোগ করে তদন্ত পূর্বক তার লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করেন ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মনিপুর গ্রামের মো. হায়দার আলীর ছেলে আমিনুল ইসলাম।  যেখানে তিনি উল্লেখ করেন গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ৫ থেকে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার মো. মোস্তফা কামাল নিয়োগের সময় ১ নম্বর ওয়ার্ডের শিরির চালা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা থাকলেও তিনি নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য মন্ত্রণালয়ে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বলে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিয়োগের সময় তিনি ১ নম্বর ওয়ার্ডের শিরিরচালা এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন এবং ভোট প্রদান করেছেন। তার পিতা মৃত আব্দুল হাকিম ও ভোটার নম্বর ৩৩০৫০৬৬১৫৭০০। এই বাসিন্দা গত মিথ্যা তথ্য  মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন-২০০৯ এর পরিপন্থী উল্লেখ করে তার অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রেশন লাইসেন্স বাতিলের দাবি জানান এলাকাবাসীর পক্ষে আমিনুল ইসলাম। তার এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের মার্চের ১২ তারিখে বিচার শাখার সিনিয়র সচিব বুলবুল আহমেদ গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার কে পত্র প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে সরেজমিন তদন্ত পূর্বক মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাবার পর ৩০ এপ্রিল সরেজমিন তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও জেলা রেজিস্ট্রার মুনশী মোকলেছুর রহমান। পরে তিনি ২০১৮ সালের মে মাসের ১৪ তারিখে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।  যে প্রতিবেদনে জেলা রেজিস্ট্রার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে জেলা রেজিস্ট্রার বলেন ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসের ২১ তারিখে অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিয়োগ পেলেও তখন তিনি ৫ নম্বর ওয়ার্ড নয় বরং ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছিলেন। পরে তিনি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নয়াপাড়া গ্রামে ২ শতাংশ জমি কেনেন। পরবর্তীতে একই বছরের সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে মন্ত্রণালয় থেকে মো. মোস্তফা কামাল কে কেন তার অপরাধের কারণে লাইসেন্স বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়।

কিন্তু আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় থাকায় এবং আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে তৎকালীন সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তিনি। মোস্তফা কামাল ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখে স্থানীয় এমপি ইকবাল হোসেন সবুজের একটি ডিও লেটার নেন। যেখানে ইকবাল হোসেন সবুজ আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীকে মোস্তফা কামালকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করেন। প্রসঙ্গত তিনি যখন অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ পান সেসময় একই আসনের এমপি রহমত আলীর ক্ষমতার বলেই হয়েছেন বলেও জানা যায়। মো. মোস্তফা কামাল যে বাসিন্দাগত মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন সেটি ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদের দুইজন চেয়ারম্যান সালাহ্ উদ্দিন সরকার ও আবু বকর ছিদ্দিক লিখিত ভাবে জানিয়েছেন। সালাহ্ উদ্দিন সরকার ২০১৮ সালের মার্চের ৩০ তারিখ এবং আবু বকর ছিদ্দিক ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে লিখিতভাবে জানান। তারা দুইজন’ই লিখিত ভাবে বলেন,মোস্তফা কামাল ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এবং ২০১৩ সালেও তিনি ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসেবে ভোটদান করেছেন। এবং কাগজে ২০১৫ সালের জুলাই মাসের ২৭ তারিখে মোস্তফা কামাল জমি কিনে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা বলেও উল্লেখ করা হয়। একই সাথে ২০১৮ সালের ৪ঠা জুলাই চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দিকের দেয়া মোস্তফা কামালের পক্ষে প্রত্যায়ন পত্রটি সঠিক নয় বলেও জানান তিনি। দুই জন চেয়ারম্যান একই কথা বললেও ভিন্ন কথা বলেন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ও ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক শেখ এমদাদ। তিনি ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল জেলা রেজিস্ট্রারের তদন্তের সময় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন,মোস্তফা কামাল ২০১৩ সাল থেকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নয়াপাড়া গ্রামে বসবাস করছে এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণও করছে। দুই জন চেয়ারম্যান ও তদন্ত কর্মকর্তাদের তদন্তের পরও যখন প্রমাণিত মোস্তফা কামাল ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তখন একজন মেম্বার কেন ভিন্ন কথা বললো এর কারণ খোঁজতে গিয়ে বেরিয়ে গেল থলের বিড়াল। বিষয়টি সম্পর্কে মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা আমিনুল ইসলাম বলেন,মোস্তফা কামাল ও স্থানীয় মেম্বার এমদাদ সম্পর্কে মামা ভাগ্নে। এছাড়াও বিষয়টি নিয়ে মোটা অংকের অর্থের লেনদেন হয়েছে যার কারণে এমদাদ মেম্বার অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন।  তাছাড়া মোস্তফা কামালের সহযোগী সাইদুর রহমান সুরুজ স্থানীয় যুবলীগ সভাপতি। এসব কারণেই মূলত আওয়ামীলীগের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমেই তারা এখনো বহাল তবিয়তে। অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিয়োগ পেয়েই বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগও কম নয়। বাল্য বিয়ে পড়ানোর অভিযোগে জেলও খাটেন মোস্তফা কামালের সহযোগী সাইদুর রহমান সুরুজ।

এবিষয়ে অভিযুক্ত অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার মোস্তফা কামাল বলেন,আমাকে সরকার দায়িত্ব দিয়েছে আমি পালন করছি এর বেশি আর কিছু বলতে পারবো না। আমি যেভাবে পারি খুশি করে এনেছি রিজিকে থাকলে থাকবে না থাকলে নাই। আপনারা বিস্তারিত তাদের কাছেই শুনুন।

এই প্রসঙ্গে জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না,নথি দেখে ব্যবস্থা নিবো। তবে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এমন কাজ তিনি করতে পারেন না,বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুতই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

( বাল্য বিবাহ সহ অস্থায়ী নিকাহ্ রেজিস্ট্রার পদকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামীলীগের ক্ষমতার দাপটে ও ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে তিনি যে অপকর্ম করেছেন তার বিস্তারিত পড়ুন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে।)