দুর্নীতি ও অনিয়মের এক অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলওয়েতে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সব সময় যেন থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এ যেন এক দুর্নীতির স্বর্গ রাজ্য। আর এই স্বর্গ রাজ্যের এক একচ্ছত্র রাজা হিসেবে বহুল পরিচিত ফজলে করিম চৌধুরী। তার হাত ধরেই দুর্নীতির এক চরম মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৬ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেন ফজলে করিম চৌধুরী। এরপর একেএকে ২০১৮ সালের নির্বাচন ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে তৃতীয়বারের মতো একই কমিটির সভাপতি হন ফজলে করিম।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ফজলে করিম তার আঁখের গোছাতে থাকে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে রেল থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বড় বড় প্রজেক্ট, করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সীমাহীন দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতিকে সামাল দিতে তৈরি করেছেন নিজের এক বিশাল সিন্ডিকেট।
ফজলে করিমের এই সিন্ডিকেটের প্রধান ছিলেন তার নিজের ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী ও শ্যালক খান মোহাম্মাদ এহসান।
জানা যায়, ফজলে করিম চৌধুরী যেকনো প্রকল্পে দরপত্র আহ্বান না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিযোগিতাহীন ভাবে যন্ত্রাংশের মূল্য কয়েকশ গুণ বাড়িয়ে কাজ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য রেলওয়ের কর্মকর্তাদের দিতেন অমানষিক চাপ এবং করতেন অপমান ও অপদস্ত।
এছাড়াও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামানের কাছ থেকে আদায় করে নেন ৩৬ কোটি টাকা মূল্যের রেলওয়ের ডিজিটাল ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ। যা উদ্বোধনের দিন থেকে এখন পর্যন্ত এক দিনের জন্যও রেলওয়ের কোনো কাজে আসেনি। যার একটি স্থাপন করা হয় ঢাকার কমলাপুরে এবং অন্যটি স্থাপন করা হয় রাজশাহীতে।
জানা যায়, এই ডিজিটাল ওয়াশিং প্ল্যান্ট দুটি মাত্র ১১ কোটি টাকায় স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে ইতালির কোম্পানির মাধ্যমে দরপত্রের অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন রেলওয়ের অন্য এক ব্যবসায়ী। তবে ফজলে করিম ও তৎকালিন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের হুমকির কারণে দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে পিছু হটেন ওই ব্যবসায়ী।
এদিকে ক্ষমতা প্রদর্শন, ব্ল্যাকমেইলিং, হুমকি ও অপমান-অপদস্তের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করত ফজলে করিমের সিন্ডিকেট। এর মাধ্যমে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বাধ্য করে ক্রয় করা হতো খোলা দরপত্র আহ্বান ছাড়া সরাসরি ডিপিএম পদ্ধতিতে কয়েকশগুণ বেশি মূল্যে যন্ত্রাংশ।
এছাড়াও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে ২০১৮ সাল থেকে তার আরেকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান Maximum Support Limited দিয়ে IRCON International India এর মাধ্যমে ভাগিয়ে নেন রেল সিগনালিং, রেলপথ ও ব্রিজ নির্মাণের শত শত কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্প।
ফজলে করিমের মাধ্যমে একদিকে যেমন রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন, অন্যদিকে পদ-পদবী লোভি কিছু কর্মকর্তা হয়েছেন পুরস্কৃতও।
শেষ নেই ফজলে করিমের দুর্নীতি ও অনিয়মের। তিনি একাধারে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজনের খুবই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। তাদের ছত্রছায়ায় ফজলে করিমের ছেলে ফারাজ করিম ও খান মোহাম্মদ এহসানের মূল প্রতিষ্ঠান Next Generation Graphics Ltd ইন্ডিয়ান কোম্পানি Elixir Engineering এর স্থানীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়ে রেলওয়েতে নাম লেখান নতুন ব্যবসার।
Elixir Engineering এর প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়ে ট্রেনের ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ ক্রয়ের বৈদেশিক দরপত্রে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে সূক্ষ্ম জালিয়াতির মাধ্যমে দরপত্রের প্রাক্কলিত মূল্য বাড়ান বেশ কয়েকগুণ।
বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কর্তৃক ইস্যুকৃত হুবহু একই ধরনের যন্ত্রাংশ প্রতি পিস ১০ থেকে ২০ হাজার রুপি (১০০ থেকে ২০০ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ) মূল্যে সরবরাহ করেছে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে ঠিক একই ধরনের যন্ত্রাংশ ক্রয় করেছে প্রতি পিস দুই লাখ থেকে ৪ লাখ টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার মূল্যে। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থের গুরুতর অপচয় লক্ষণীয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে এই অনিয়ম বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন সচেতন মহল। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় অথের্র অপচয় রোধে যথাযথ সুষ্ঠু ভূমিকা রাখার তাগিদও দেন তারা।
এছাড়াও ফজলে করিম চৌধুরীর নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে কালো-তালিকাভুক্ত করার দাবিও জানান তারা।
তথ্য সূত্র: বাংলা আউটলুক