কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সংঘাত-সহিংসতার পর বর্তমানে চট্টগ্রামে জনজীবন এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাড়েছে কর্মচাঞ্চল্য। তবে সহিংসতার প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও নগর পুলিশে। যেখানে এই চার সংস্থার প্রায় সাড়ে ১১শ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
ওই সময় বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠা-নামা করলেও কাস্টমস জটিলতায় বন্ধ ছিল আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। যেখানে পাঁচ দিনে প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে বন্দর-কাস্টমস। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চারটি ট্রেনের ৪০টি বগি ভাঙচুর ও রেলপথ ক্ষতি হওয়ায় ২১ কোটি ৭০ লাখ টাকার।
অন্যদিকে নগরীতে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশ বক্সে আগুন, ১৩টি গাড়িসহ চারটি মোটরসাইকেলে আগুনের ঘটনায় সিএমপির ৪৬ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
বন্দর-কাস্টমসের ক্ষতি প্রায় ১১০০ কোটি টাকা
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার মুশফিকুর রহমান গতকাল শনিবার বিকালে দেশ বর্তমানকে বলেন, সম্প্রতি সহিংসতায় কাস্টমসের কার্যক্রমে প্রভাব পড়েছে। দেশব্যাপী ইন্টারনেট না থাকায় বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) রাত থেকে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। গত কয়েক মাসের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ২১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হতো। এই হিসাবে পাঁচ দিনে প্রায় (শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার) ১ হাজার ৮৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। তবে বর্তমানে পুরোদমে কাজ চলমান থাকায় কিছুুদিনের মধ্যে ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে যাবে বলেও দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক দেশ বর্তমানকে বলেন, গত দুই দিনে প্রায় ৮ হাজার আমদানি পণ্যের কনটেইনার খালাস হয়েছে। গতকালও পণ্য খালাসের চাপ ছিল। পণ্য খালাসের চাপে বন্দরে গাড়ির জট তৈরি হলেও কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জানান তিনি।
বন্দর সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হয়ে থাকে। প্রতি কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে বন্দরের চার্জ ৪৫ মার্কিন ডলার। সেই হিসাবে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে বন্দরের রাজস্ব আদায় হয় ৪ লাখ ৫ হাজার মার্কিন ডলার (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসাবে ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা)।
বর্তমানে রপ্তানিপণ্য জাহাজীকরণ হতে না পারায় কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে এক দিনে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বাবদ বন্দরের আয় কমেছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ও বাল্ক পণ্যেও প্রায় সমপরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে। ফলে প্রতিদিন বন্দরের আয় কমেছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। গত পাঁচ দিনে এই সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি টাকা হতে পারে। তাহলে পাঁচ দিনে বন্দর ও কাস্টমসের ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের প্রায় ৯২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রতিবছর প্রায় ৩২ লাখ একক কনটেইনার পণ্য হ্যান্ডেলিং করে এই বন্দর। বর্তমানে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) পাশাপাশি পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনায় রয়েছে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ক্ষতি ২২ কোটি টাকা
এদিকে দুষ্কৃতকারীরা রেলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে বলে জানান পূর্বাঞ্চল রেল কর্তৃপক্ষ। সহিংসতার সময় চারটি ট্রেনের ৪০টি বগি পুড়িয়ে দেওয়া এবং ভাঙচুর করা হয়েছে রেলের ইঞ্জিন ও কোচ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেলপথ। এতে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। রেলওয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চারটি ট্রেনের ৪০টি কোচ ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের ৭টি, চট্টলা এক্সপ্রেসের ১৩টি, জামালপুর এক্সপ্রেসের ৬টি, পারাবত এক্সপ্রেসের ৮টি ও কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের ২টি বগি ভাঙচুর করা হয়। কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের চারটি বগি পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া চট্টলা এক্সপ্রেস, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ও কর্ণফুলী কমিউটারের ইঞ্জিন ভাঙচুর করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী,পূর্বাঞ্চলের আওতায় ঢাকা বিভাগের যাত্রীদের ফেরত দিতে হবে ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের যাত্রীদের ফেরত দিতে হবে ৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
জানা যায়, গত ১৮ জুলাই থেকে সব ধরনের রেল চলাচল বন্ধ রাখে। কার্যত এরপর থেকে আর কোনো রেল চলাচল করেনি।
তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নিরাপত্তায় চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে গতকাল শুক্রবার চারটি তেলবাহী ট্রেন চলাচল করে। রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায়। ১৮ থেকে ২৩ জুলাই বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন চলাচল না করায় যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দিতে হবে। এর পরিমাণ ১৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (চট্টগ্রাম) মো. সাইফুল ইসলাম জানান, ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল না হওয়া পর্যন্ত যাত্রীদের কাছে বিক্রি করা টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে ট্রেন চলাচলের বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও জানান তিনি।
সিএমপির ক্ষতি প্রায় অর্ধকোটি টাকা
অন্যদিকে সহিংসতার হামলার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশের ক্ষতি হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। বাকিদের গ্র্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি-পিআর) কাজী মো. তারেক আজিজ দেশ বর্তমানকে বলেন, ‘আন্দোলনের নামে চলা সংঘর্ষে আহত হয়েছে সিএমপির ৪৫ জন পুলিশ সদস্য। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশের ১৩টি গাড়িসহ চারটি মোটরসাইকেল।
এ ছাড়া চান্দগাঁও থানার মূল ফটক ভাঙচুর করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিসিটিভি ক্যামেরা। এ ছাড়া বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। দুর্বৃত্তদের হামলায় চারটি সার্ভিস সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে সিএমপির ক্ষতি ৪৬ লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, নগরীতে সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।