লোকমুখে প্রচলিত আছে, বাসের চেয়ে ট্রেন ভ্রমণ বেশি নিরাপদ। তবে এখন সেটি কল্প-কাহিনীর গল্পের মতো। যত জল্পনা-কল্পনা সবই এখন রেলকে ঘিরে। একের পর এক দুর্ঘটনা, ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন, বগি লাইনচ্যুত, পাথর নিক্ষেপের মতো ঘটনা সবই ঘটছে এই নিরাপদ বাহন ট্রেনে। এবার নিরাপত্তাহীনতার তুঙ্গে উঠেছে সেবাধর্মী এই রাষ্ট্রয়াত্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ে। ঘটেছে চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম ঘটনাও।
সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে (ট্রেন নং ৭২৪) এক তরুণীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় ট্রেনে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের চার কর্মচারীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। মঙ্গলবার (২৫ জুন) দিবাগত রাত সাড়ে চারটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। এদিন রাত ১০ টায় সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি বুধবার সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম স্টেশন পৌঁছায়।
গ্রেপ্তারকৃত চারজন হলো- মোহাম্মদ জামাল (২৭), মোহাম্মদ শরীফ (২৮ ), রাশেদুল ইসলাম (২৭) ও আবদুর রব রাসেল (২৮)। তারা চারজনই রেলওয়ের প্রভাবশালী ঠিকাদার শাহ আলমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসএ কর্পোরেশনের কর্মচারী। এছাড়াও দায়িত্বে অবহেলায় আবদুর রহিম নামের একজন ট্রেন পরিচালককেও (গার্ড) সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ২০ বছর বয়সী ওই তরুণী উদয়ন এক্সপ্রেসে করে চট্টগ্রামে আসছিলেন। টিকিট না পাওয়ায় ভুক্তভোগী তরুণী ট্রেনের খাবারের বগিতে অবস্থান নেয়। ওই সময় এসএ কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মী প্রথমে তাকে উত্যক্ত করে। পরবর্তীতে ভোররাতের দিকে ওই বগিতেই তাকে একের পর এক পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী তরুণীর। ওই তরুণী আত্মীয়দের সঙ্গে ভৈরবে থাকলেও তার নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায়। তিনি বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আসছিলেন।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানা সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত চারজনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের চাওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে আছে।
এদিকে উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বুধবার (২৬ জুন) সন্ধ্যায় পূর্বাঞ্চলের সহকারী প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক নোটিশের মাধ্যমে মেসার্স এসএ কর্পোরেশনের পরিচালনাধীন চট্টগ্রাম-সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের ৭১৯/৭২৪ (পাহাড়িকা ও উদয়ন) এবং সিলেট-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের ৭২০/৭২৩ (পাহাড়িকা ও উদয়ন) ট্রেনের উভয়পথে ক্যাটারিং সার্ভিসের সকল কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ।
দেশের প্রতিটা আন্তঃনগর ট্রেনে যাত্রীদের সুবিধার্থে খাবারের কোচ সংযুক্ত আছে। ঠিকাদারদের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। এসএ কর্পোরেশন বাংলাদেশ রেলওয়ের ঠিকাদারি কাজ ছাড়াও অন্তত ১০ জোড়া ট্রেনের ক্যাটারিং ও অনবোট সার্ভিস পরিচালনা করছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের পার্কিং পরিচালনা, পুরাতন স্টেশনস্থ হোটেল হেরিটেজ, নতুন রেল ভবনের দ্বিতীয় তলার হোটেল বিরতি, চট্টগ্রাম চেম্বার ভবনস্থ রেলওয়ের মালিকানাধীন ফ্লোরসহ শতাধিক স্থাপনা ইজারা নিয়ে দেড় যুগ ধরে রাজত্ব চালাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধীকারি শাহ আলমের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। ক্ষমতাবলে রেলের জায়গা দখল করে স্থাপন করেছেন স্বপ্নিল গ্রামার স্কুল। এছাড়াও চট্টগ্রামের সিটি কলেজের পাশে বরিশাল কলোনীর আরেক অংশে ট্রাক স্ট্যান্ডের নামে রেলওয়ের জায়গা ইজারা নিয়ে দুই শতাধিক দোকান বিশিষ্ঠ বাণিজ্যিক মার্কেট নির্মাণ করেছেন শাহ আলম।
ধর্ষণের বিষয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম শহীদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, ইতোমধ্যেই আমরা ধর্ষণের সাথে জড়িত এসএ কর্পোরেশন ক্যাটারিং সার্ভিসের চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি। ভুক্তভোগী ওই তরুণী বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে আছে। তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার হাছান চৌধুরী দেশ বর্তমানকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নজরদারী থাকার পরও ট্রেনে এমন ধর্ষণের ঘটনা বেশ দুঃখজনক। এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহীনিকে আরো সর্তক থাকতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এসএ কর্পোরেশনের কার্যক্রম স্থগিত ও ধর্ষণের ব্যাপারে জানতে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শাহ আলমের ব্যবহৃত মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলাম দেশ বর্তমানকে বলেন, এটি খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। এই প্রথমবার ট্রেনে এমন নেক্কার একটি ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর রেল জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিবে।