শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ড মজবুত করতে দরকার মানসম্মত শিক্ষক। আর এরকম শিক্ষক তৈরি করতে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনা ব্যতীত বিকল্প নেই। তবে এজন্য রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। মেধাবীরা যাতে এই পেশায় আসতে আগ্রহী হয় সেই ব্যবস্থাটুকু রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এজন্য এই পেশায় আর্থিকসহ নানা সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। তাহলেই এই পেশায় আসতে প্রতিযোগিতা বাড়বে।
একটি রাষ্ট্রের উৎকর্ষ সাধনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি তার জনগণের মধ্যে সুশিক্ষার হার বাড়ানোয় জরুরি। এজন্য রাষ্ট্রকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের মত মৌলিক বিষয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অথচ আমরা প্রতি বছর বাজেটে সেটাকে কেন জানি এড়িয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যেও শিক্ষায় যতটুকু বাজেট দেয়া হয়, তার অধিকাংশই চলে যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিভিন্ন প্রকল্পে। অথচ যারাই নানা খাটুনি খেটে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করছেন, সেসব শিক্ষকদের দিতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কেন জানি অনীহা।
দেশের ৯৭ শতাংশ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো এমপিও নির্ভর। তবে প্রতিবছর কিছু কিছু স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ হলেও ৩টা ছাড়া বাংলাদেশের সকল আলিয়া মাদ্রাসা এখনো বেসরকারি। অথচ মূলধারার শিক্ষাক্রমে তারাও অন্তর্ভুক্ত। বরং স্কুল-কলেজের চেয়ে মাদ্রাসায় সাবজেক্ট আরো বেশি পড়ানো হয়।
সম্প্রতি এনটিআরসিএ ৫ম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সেখানে ৯৭ হাজার শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে ২৩ হাজার। অথচ সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় দেখা যায়, পদের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা কয়েকশগুণ পর্যন্ত বেশি। এমনকি ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণির পদমর্যাদার কোনো একটি পদের বিপরীতে কয়েকশ’ জন আবেদনকারী থাকেন। সেখানে এনটিআরসিএ-র অর্ধেকের বেশি পদই ১ম ও ২য় শ্রেণি পদমর্যাদার হওয়া স্বত্বেও আবেদনে সাড়া নেই।
কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি একজন কর্মকর্তা ৯ম গ্রেডে চাকরিতে প্রবেশের পর মূল বেতনের পাশাপাশি ৪৫% এর বেশি বাড়িভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতাসহ আনুষাঙ্গিক নানা ভাতা এবং শতভাগ উৎসব ভাতা পান। সাথে বদলি ও প্রমোশনের সুযোগ রয়েছে। সেখানে ৯ গ্রেডের একজন বেসরকারি প্রভাষক মূল বেতন সরকারির সমপরিমাণ পেলেও বাসা ভাড়া পান ১০০০ টাকা ও চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। এছাড়া উৎসব ভাতা পান মাত্র ২৫ শতাংশ। তারউপর অবসর ও কল্যাণফান্ডের জন্য কেটে নেয়া হয় ১০ শতাংশ। তার ওপর সম্প্রতি বিভিন্ন উপজেলায় যুক্ত হয়েছে বাধ্যতামূলক পেনশান। সবমিলিয়ে দেখা যায়, একজন প্রভাষক মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা নগদে তুলতে পারেন, তাও মাসের ১০/১২ তারিখ। আর উৎসব ভাতা একাউন্টে ক্রেডিট হতে হতে বেশিরভাগ সময় উৎসবই শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া বদলিও নেই। ফলে আর্থিকসহ নানা সংকট ও সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষকতা পেশায় তরুণ মেধাবীরা আসতে চায় না। এতে শিক্ষা ব্যবস্থা দিনদিন হুমকির মুখে পড়ছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমান সরকার গতানুগতিক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে। তবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা না বাড়ালে তারা সেটি বাস্তবায়নে কতটুকু সম্ভবপর হবে সেটা দেখার বিষয়। কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই দিনে স্বল্প বেতনে সংসার চালানো দুরূহ। ফলে সংসারের খাতিরে বাধ্য হয়েই শিক্ষকদের নিজের পেশার পাশাপাশি ভিন্ন কাজে মনযোগ দিতে হচ্ছে। এতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের যে সময়টুকু দেয়া প্রয়োজন তারা অনেক সময় সেটি দিতে পারছেন না। এতে কারিকুলাম বাস্তবায়নে ব্যাঘাত ঘটছে।
পাশাপাশি তরুণ মেধাবীরাও এই পেশায় না আসায় তেমন প্রতিযোগিতা চোখে পড়ছে না। ফলে নতুন কারিকুলাম চালুর যে উদ্দেশ্য তা ব্যাহত হচ্ছে। এই অবস্থায় শীঘ্রই শিক্ষকতা পেশায় বেতন-ভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী বাজেটে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে প্রণোদনা ঘোষণা না করলে আগামী দিনে মানসম্মত শিক্ষকের সংকট তৈরি হওয়ার আশংকা করছেন শিক্ষাবিদরা।
লেখক : প্রভাষক, হাশিমপুর ইসলামিয়া মকবুলিয়া কামিল (এমএ) মাদ্রাসা।