সন্তানের সেই ডাক পোড়াচ্ছে খোকনকে

যাদের জন্য আমার বেঁচে থাকা। তারা সবাই তো পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। আমি কেন বেঁচে গেলাম। কার জন্য বাঁচব। কেন সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বারান্দার মেঝেতে চিকিৎসাধীন খোকন বসাক (৪২) এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) বিকেলে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার।

হাসপাতালের মেঝেতে বুক, পিঠ ও হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছেন খোকন। সন্তানদের কথা স্মরণ করে শুধুই কাঁদছেন তিনি। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে পড়েছেন। কথা বলার সময় সময় বার বার গলা থেমে যাচ্ছে তার। ঘুম থেকে যে সন্তান তাকে জাগিয়ে তুলেছে, তাদের বাঁচাতে না পারার কষ্ট আরও বেশি পোড়াচ্ছে তাকে।

এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার গভীররাতে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পারুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ায় মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে।
খোকন বসাকই একমাত্র ভাগ্যবান যিনি বেঁচে ফিরলেও আগুনের তান্ডব থেকে বাঁচতে পারেনি তার পুরো পরিবার। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় খোকনের বাবা কাঙ্গাল বসাক (৬৮), মা ললিতা বসাক (৫৭), স্ত্রী লাকি বসাক (৩৩), ছেলে সৌরভ বসাক (১২) ও মেয়ে শান্তি বসাক (৬)। ছেলে পড়ত সপ্তম শ্রেণিতে, মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে চমেকের বার্ন ইউনিটের কর্তব্যরত চিকিৎসক রাইসা জানান, খোকন বসাকের বাম হাত, বুক, পিঠ ও মুখের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে পুড়ে গেছে। শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খোকন শংকামুক্ত কিনা তা বলা যাচ্ছে না। কিছু পরীক্ষা দিয়েছি। সেগুলোর রিপোর্ট পাওয়ার পর বলা যাবে। খোকন পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। আগুনে মা-বাবা, স্ত্রী সন্তানের সাথে সেটিও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে খোকন বসাক বলেন ‘ঘরের একটি কক্ষে থাকতেন আমার মা ও ছেলেমেয়ে। আরেক কক্ষে থাকতাম আমি এবং স্ত্রী। অন্য কক্ষে থাকতেন বাবা। প্রথমে আমার ছেলে আগুন আগুন বলে চিৎকার করে উঠে। এরপর আমি বারান্দায় যাই। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়ার দরজা খুলে দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। পরিবারের সবাইকে আমার পেছন পেছন আসতে বলে আমি বাইরের দিকে দৌড় দিই।
আমি আগুন অতিক্রম করতে সক্ষম হলেও পরিবারের আর কেউ বের হতে পারেননি। ঘরের ভেতরেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় তারা। আমি যখন বের হয়েছি। তখন রান্নাঘরের পূর্ব পাশে আগুন বেশি দেখতে পাই। রান্নাঘরের দক্ষিণ পাশে আছে টিউবওয়েল। সেখানে ছিল তিনটি পাতার বস্তা। টিউবওয়েলের পাশে ছিল আমার অটোরিকশাটি। দেখলাম, সিএনজি অটোরিকশার সামনে অংশ দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঘর থেকে বের হয়ে নিজে পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি। তখন আমার পিঠে আগুন জ্বলছিল। এ অবস্থায় তাদের বাঁচাতে আর সক্ষম হয়নি।’

জানা গেছে, সেমিপাকা টিনশেডের ঘরটিতে দেড় বছর ধরে থাকতেন খোকনরা। তারা তিন ভাই। অপর দুই ভাই অন্য জায়গায় থাকেন। চুলা থেকে আগুনের সুত্রপাত হয়নি বলে দাবি করে খোকন বলেন,‘আমার বিশ্বাস চুলা থেকে আগুন ধরেনি। রান্নাঘর এলোমেলো ছিল না। কোন লাকড়ি বা পাতা ছিল না। চুলার ওপর বসানো ছিল পানির হাঁড়ি আর মুখে ছিল ভাতের হাঁড়ি। রান্নার ঘরের পাতা বা লাকড়ি ছিল চুলা ধেকে অন্তত চারফুট দূরত্বে। চুলা থেকে আগুন সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে কী কারণে আগুন লেগেছে সেটা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন।’