প্রকৃত রিজার্ভ কত, ধাঁধা

# গত দুই বছরে প্রতি মাসেই গড়ে ১০০ কোটি ডলার করে কমেছে # রিজার্ভ বিপজ্জনক পর্যায়ে না গেলেও উদ্বেগজনক: জাহিদ হোসেন # রিজার্ভের বর্তমান পরিমাণ অর্থনীতির জন্য বিপদ সংকেত: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা চেষ্টার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং প্রতিদিনই কমছে। এমন পরিস্থিতিতে রিজার্ভের হিসাবায়ন নিয়ে চলছে এক ধরনের লুকোচুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্যে বলা হচ্ছে এখন রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই পরিমাণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এর পরিমাণ আরও কম।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ যা বলা হচ্ছে, সেটাও দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদ সংকেত। এই মুহূর্তে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ আছে, তা তিন মাসের আমদানি মূল্যেরও কম হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য এই পরিমাণ মজুদ একটা বিপদ সংকেত। এখনই বিপদের ঝুঁকিতে পড়ছে, এমন কয়েকটি খাতও উল্লেখ করেন ড. ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, রিজার্ভ কমে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না।

রিজার্ভ নিয়ে আমাদের জানার বাইরে কিছু একটা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে কত বৈদেশিক মুদ্রা ঢুকছে এবং কত মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব রিজার্ভ দিয়ে মিলছে না। লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। এখন যে রিজার্ভ আছে, তা বিপজ্জনক পর্যায়ে না গেলেও উদ্বেগজনক পর্যায়ে।

তিনি বলেন, প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন ডলার কমছে। এই অবস্থায় চললে এক সময় ফুরিয়ে যাবে। তিনি জানান, এই হিসাব বেশ কিছুদিন ধরে ঋণাত্মক। এর অর্থ হলো, আমাদের জানার বাইরে কিছু একটা ঘটছে। তিনি দাবি করেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ৪ অক্টোবর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের (আইবিএফবি) বার্ষিক সম্মেলনে এ তথ্য দেন জাহিদ হোসেন।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। অর্থাৎ দুই হাজার ৯০ কোটি ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৭০০ কোটি ডলারের কম।

২০২১ সালের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল চার হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৭৪ কোটি (২৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন) ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে দুই হাজার ৯০ কোটি (২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন) ডলার।

এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। আইএমএফ সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি বা ১৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছরে প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি বা এক বিলিয়ন ডলার করে কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে প্রকৃত রিজার্ভ জমা আছে, তা দিয়ে শুধু তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে, অন্য কোনও খরচ বহন করা সম্ভব নয়। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সংকটে পড়েছে এমনটিই বলা না গেলেও রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত ছিল গত জুনে প্রকৃত রিজার্ভ দুই হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার, গত সেপ্টেম্বরে দুই হাজার ৫৩০ ডলার এবং আগামী ডিসেম্বরে দুই হাজার ৬৮০ ডলারে রাখতে হবে। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী, রিজার্ভ রাখতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

আইএমএফের দেয়া হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায়, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা অর্থ ও স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এসডিআর) হিসেবে থাকা ডলার বাদ দেওয়ার পর পাওয়া যায় প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে আইএমএফের পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ নেই বাংলাদেশের। বর্তমানে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে রয়েছে। এই দলের আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে রিজার্ভের পতন ঠেকানোসহ শর্ত পূরণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা।

সাধারণত, ব্যাংকগুলোতে ডলার আসে প্রবাসী ও রফতানি আয়, ফ্রিল্যান্সারদের আয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ও অনুদানসহ বিদেশি বিভিন্ন আয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সীমার বেশি ডলার মজুত হলে ব্যাংকগুলো তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে দেয়। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন ঋণ, অনুদান, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে কর্মরতদের আয় সরাসরি যুক্ত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে। তখন রিজার্ভ বাড়ে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় আগের চেয়ে কমে গেছে। এমনকি বিদেশি ঋণের ছাড়, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগেও নেই কোনও সুখবর। বলা চলে ডলারের সব উৎসে চলছে ভাটার টান। অপরদিকে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। এ ঋণে সুদের হারও এখন বেশি। অর্থাৎ ডলার আসছে কম, কিন্তু পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি। এমন পরিস্থিতি রিজার্ভ সংকটের চাপকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভ কমতে শুরু করে মূলত গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ডলার-সংকট শুরু হয়।

ডলারের দাম গত দেড় বছরে ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকায় উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের জোগান ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে সময়ে-সময়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম প্রতি মাসেই বাড়ছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি মাস থেকে পণ্য বা সেবা খাতের রফতানি আয়ের ডলার ও প্রবাসী আয়ের ডলার কেনায় দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ টাকা। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো এখন আমদানিকারকদের কাছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দামে ডলার বিক্রি করছে। তবে বাস্তবে এই দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে খুব কম। এ কারণে অবৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনও বেড়ে গেছে।

হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোই বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এভাবে টাকা পাঠানোর কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আসলে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে দেশে আসে না বা সরকারি হিসাবে যোগ হয় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের বড় অংশ রাখা আছে ডলারে। যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৮৪৫ কোটি ডলার। গত বছরের জুনে যা ছিল তিন হাজার ১৯০ কোটি ডলার। এর বাইরে ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, জাপানিজ ইয়েন, চীনের ইউয়ান, সিঙ্গাপুর ডলারে বিনিয়োগ করে রেখেছে। এছাড়া স্বর্ণ কেনা আছে ৮৬ কোটি ডলারের। গত বছরের জুনে স্বর্ণ কেনা ছিল ৮২ কোটি ডলারের।