চট্টগ্রামে ডেঙ্গু সংক্রমণে অধিক ঝুঁকিতে শিশুরা

বৈশ্বিক মহামারি করোনা পর নতুন আতঙ্ক ডেঙ্গু। দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ইতো মধ্যে লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে। সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের জন্যবিপদ মনে করছেন চিকিৎসরা। চট্টগ্রামে অন্যান্য বয়সীদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু।

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১১২ জন রোগীর মধ্য ৪২ জনই শিশু। এছাড়া অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেওআছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুরা। হাতে কিংবা পায়ে ক্যানোলা লাগিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে এসব শিশুরা চিকিৎসা নিচ্ছে।

১৫ মাস বয়সী হামিদা। গত ২২ আগস্ট থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চমেক হাসপাতালের ৯ নং শিশু মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নারে ভর্তি আছে। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর জলিল নামক এলাকা থেকে আসা হামিদার মা নুসরাত জাহান জানান, ২১ আগস্ট থেকে প্রচণ্ড জ্বরেআক্রান্ত হয়। পরীক্ষা করার পর ডেঙ্গু ধরা পড়লে পরের দিন চমেক হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করাই। শুরুতে হামিদার গায়ে জ্বর এবংপায়ে লালচে দাগ দেখা দেয়।আগের মতো এখন খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না। তবে আগের থেকে শারীরিক অবস্থা একটু উন্নতির দিকে বলে জানান এই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর মা।

একই কর্নারেচিকিৎসা নিচ্ছে ১৬ মাস বয়সী হামিম ইসলাম। সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড এলাকার বাসিন্দা ও শিশুটির মা তাছলিমাআকতার জানান, বাচ্চা ছোট হওয়ায় কিছু বলতে পারছে না, কষ্ট হলে শুধু কান্নাকাটি করে। শিশুটি গত শনিবার থেকে হাসপাতালেভর্তি বলে জানান তিনি।

১৩ মাস বয়সী আরমানকে নিয়ে বেকায়দায় আছে নগরীর খুলশী আমবাগান এলাকার বাসিন্দা ঝিনুক আকতার। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার থেকে আমার বাচ্চার ভীষণ জ্বর। বৃহস্পতিবার তার ডেঙ্গু ধরা পড়লে বাচ্চাকে নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হই। ছোট বাচ্চা হওয়ায় কিছু বলতে পারে না, প্রায় সময় কান্নাকাটি করে।

নগরীর কালুরঘাট সিএন্ডবি এলাকা থেকে আসা গত শুক্রবার থেকে ভর্তি থাকা২১ মাস বয়সী শুভাশ্রী বিশ্বাসের মা বলেন, শুরতেই অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করাই। ওখানে পরীক্ষা করাতে বললে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপরএখানে ভর্তি করি।আমার বাচ্চার এখনও জ্বর বেশি। প্রায় সময় ১০২ ডিগ্রি জ্বর থাকে। ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়ে চেষ্টা করছেজ্বর কমানোর।

নগরীর কদমতলী মতিয়ার পুল এলাকা থেকে আসা ১১ মাস বয়সী সাদিয়া আফরিন মনিরা ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। গত ১৯ আগস্ট জ্বর ওঠার পর ডাক্তার দেখালে পরীক্ষাতে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। গত চারদিন ধরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ডেঙ্গু হওয়ার পর থেকে বাচ্চার ওজন কমার কথা জানান শিশুটির মা। বর্তমানে শিশুটির ওজন কমে মাত্র ৬ কেজিতে দাঁড়িয়েছে বলে জানান হাসপাতালে থাকা শিশুটির নানী।

গতকাল শুক্রবার বিকালে সরেজমিনে চমেক হাসপাতালের শিশুদের দুটি(৮ও ৯) ওয়ার্ডে গেলে দেখা যায়, ৪২জন রোগী ভর্তি আছেন। এ সময় ডেঙ্গু কর্নারের ৪২ জন রোগীর মধ্যে অন্তত ১৪ ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকের সাথে কথা হয়। অভিভাবকরা জানান, শিশুদের নিয়ে তারা খুবই কষ্টে আছেন, কেননা ছোট্ট শিশুরা চিকিৎসকদের শারীরিকসমস্যারবর্ণনা দিতে পারছে না। ফলে তাদের বাহ্যিক ধরণ দেখে চিকিৎসা দিচ্ছে, যদিও ডাক্তাররা খুবই আন্তরিক।এছাড়া চিকিৎসকরা মুখে খাবার দিতে বললেও বাচ্চারা খেতে পারছেনা।এ জন্য আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।

চমেক হাসপাতালের ৯নং শিশু ওয়ার্ড সূত্রে জানা যায়, ডেঙ্গু কর্নারে জুন থেকে এখন পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ৯৮ জন। বর্তমানে ২৬জন চিকিৎসাধীন, যার মধ্যে ১ জন আইসিওতে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসের গত ২০ আগস্ট ৪ মাস বয়সী রুবেল ও ৬ বছর বয়সী রিয়ামণি মারা যায়। এর আগে মৃত্যু থাকলেও গতকাল শুক্রবার হওয়ায় সংখ্যা জানা যায়নি। এছাড়া শিশুদের ৮নং ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে ১৬ জন। মোট ৪২ জন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স শারমিন খোন্দকার দৈনিক দেশ বর্তমানকে জানান, নবজাতক থেকে ১২ বছর পর্যন্ত বয়সী রোগীদের আমরা এই ওয়ার্ডে ভর্তি করে থাকি। বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আমাদের ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু কর্নারে রোগী ভর্তি হয়। শিশুরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে উপসর্গ বলতে না পারায় খুব সাবধানে চিকিৎসা দিতে হয়। এ পর্যন্ত ভর্তির বেশির ভাগই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে বলেও জানান সিনিয়র এই নার্স।

শিশুরাই ডেঙ্গুতে বেশিআক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো.শামীম আহসান। তিনি গতকাল শুক্রবার দেশ বর্তমানকে বলেন, আমাদের মেডিকেলে বর্তমানে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে ১১২ জন, যার মধ্যে ৪২ জনই শিশু।যার মধ্যে ৯ ওয়ার্ডে আছে ২৬ জন এবং ৮ নং ওয়ার্ডে আছে ১৬ জন। ফলে আগের চেয়ে বর্তমানে ডেঙ্গুতে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আগে শিশু রোগীর সংখ্যা এত বেশি ছিল না।

শিশুদেরকে মশা থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পরিচালক বলেন, শিশুদের যাতে মশা না কামড়ায় সেজন্য মশারি ব্যবহার এবং বাসা-বাড়িতে যাতে মশার উপদ্রব না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো ডেঙ্গুর প্রকোপে পড়তে হবে বলেও জানান হাসপাতালের এই পরিচালক।

ডেঙ্গুতে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বী।

তিনি দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ শিশু। এ পর্যন্ত ২৭০ জন রোগীর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই শিশু। আজ (শুক্রবার) রোগী ভর্তি ২১ জন যার মধ্যে শিশু ৩ জন। এবারে ডেঙ্গু আক্রান্তদেরমধ্যে শিশু, বয়স্কলোক ও মহিলাদের সংখ্যা বেশি। তাই সবাইকে সর্তক ও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই বলেও জানান হাসপাতালের এই তত্ত্বাবধায়ক।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. নুরুল হক জানান, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ৭৩ জন। এর মধ্যে ৩৭ জন শিশুই।

তিনি বলেন, আমাদের মা ও শিশু হাসপাতালে এ পর্যন্ত অন্যান্য হাসপাতালে তুলনায় ডেঙ্গু কর্ণারে আক্রান্ত শিশুরা ভর্তি হয়েছে। তাদের বেশি ভাগই সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছে। এখন যারা ভর্তি আছেন তারা চিকিৎসাধীন। ভর্তি থাকা সব ডেঙ্গু রোগীরাই এখন আশঙ্কামুক্ত বলেও জানান এই পরিচালক। এছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে ডেঙ্গু কর্নারেচিকিৎসা নিচ্ছেন বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পূর্বের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কমলেও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। অন্যদিকে, আনুপাতিক হারে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এরই মধ্যে মৃত্যুছাড়িয়েছে ৫০০। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা, তা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এমন পরিস্থিতিতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই হাসপাতালগুলোতে। বাড়তি চাপের কারণে ডেঙ্গুরোগীরা যেমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন হাসপাতালে, তেমনি সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

দেশ বর্তমান/এআই