বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে কূটনৈতিক তৎপর বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিয়ে কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে চায়।
সম্প্রতি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠকের ফলাফলের একটি সারসংক্ষেপ নিয়ে পিটার হাস শিগগিরই ওয়াশিংটন যাতে পারেন। হয়তো তিনি ওয়াশিংটন থেকে নতুন কোনো বার্তা নিয়ে ফিরতে পারেন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র জাপান, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা আরও বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও সংক্ষিপ্ত নোটিসে ঢাকা সফরে আসতে পারেন। যার জন্য বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে কূটনৈতিক তৎপরতা একটা বড় ফ্যাক্টর হতে পারে।
কূটনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ব রাজনীতির বাস্তবতা থেকেই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এবার বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছে। এর আগেও নানা সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘের তৎপরতা দেখা গেছে। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা এখন আর শুধু কূটনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অনেকটাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে।
এর অংশ হিসেব গত মঙ্গলবার পিটার হাস প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। একইদিনে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এর আগে গত রোববার বৈঠক হয় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গেও। ওইদিন জাপানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির সঙ্গে গত বুধবার বিএনপির নেতারা বৈঠক করেন। প্রায় এক ঘণ্টার এই বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শামা ওয়াবায়েদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের আলোচনা হয়। এর আগেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত।
বৃহস্পতিবার (৮ জুন ) ঢাকায় নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার এইচ ই জেরেমি ব্রæ’র সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির প্রতিনিধি দল। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শামা ওবায়েদ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তৎপর সবসময়। দেশটির ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের একাধিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনে নানা ত্রæটি এবং সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অন্যতম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
সর্বশেষ একটি ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, যেখানে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই নতুন ভিসানীতির পর থেকেই বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের ধারাবাহিক তৎপরতা শুরু হয়।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক প্রভাববলয়কে শক্তিশালী করতে বিশ্বব্যাপী জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট-বড় এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে গভীর নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের এই তৎপরতা আরও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দল ও সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি। বৈঠকগুলোতে তিনি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে বাইডেন প্রশাসনের বার্তা তুলে ধরছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশে কীভাবে আগামীতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় তা নিয়েও মতবিনিময় করছেন।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আয়োজন করা যায় কি না তা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পুরোনো অবস্থানই তুলে ধরেছে এবং সেই অবস্থানেই অনড় রয়েছে।
এদিকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় ১৪ দলীয় জোটের এক জনসভায় ওই জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আলোচনার কথা বলেছিলেন। পরদিনই বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর উল্টো বক্তব্য দেন।
জাতিসংঘ বা বিদেশিদের মধ্যস্থতায় আলোচনার বিষয় নাকচ করে দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, জাতিসংঘকে মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ করতে হবে, এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট দেশে এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করব। এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করব। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এও বলেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত এখনো নেই।
রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনা বা সংলাপের প্রশ্নে গত বুধবার অন্তত তিনজন মন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আলোচনার বিষয় নাকচ করেছেন। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, আমির হোসেন আমুর বক্তব্য তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আলোচনার বিকল্প নেই।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে গতকাল তথ্য ও স¤প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বর্তমান সরকারই আগামী নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
তিনি বলেন, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তো আন্তর্জাতিকভাবে কারো সমর্থন পায়নি। তাই এখন তত্ত¡াবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছে। তারা যে সমস্ত দেশের হাতে পায়ে ধরে, সে সকল দেশে যেভাবে চলতি সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে, আমাদের দেশেও ঠিক তাই হবে।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংলাপের কথা বলে জনদৃষ্টিকে সরকার ভিন্ন দিকে নিতে চায়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্র এক সঙ্গে যায় না। তারা শুধু মিথ্যা কথা বলে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নেই। সুতরাং আগে পদত্যাগ করুন। তারপর দেখব সেটা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) কীভাবে করতে হয়। দেশের মানুষ সেটা জানে। আজ আমাদের লড়াই কিন্তু বিএনপিকে ক্ষমতায় নেওয়ার জন্য নয়। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি ।
আগের দিন বুধবার মির্জা ফখরুল বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের একেক সময় একেক বক্তব্যই তাদের চরিত্রকে প্রকাশ করে। বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেশের প্রধান জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য আগে এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে হবে। তার পরে সংলাপ হতে পারে।