স্মরণ : সাহিত্যের নক্ষত্র রাবেয়া খাতুন

রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে লেখা মানে একপ্রকার দুঃসাহস দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। তারপরও এই দুঃসাহসিক কাজটিতে হাত দিলাম একটি প্রেরণাকে প্রকাশ করবো বলে। এই মহীয়সী নারী ৩ জানুয়ারী ২০২১ সালে জীবনমঞ্চ থেকে চির বিদায় নেন।

শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অবিভাবককে স্মরণে রাখতে চাই। তিনি থাকবেন বাঙালী জাতির মননে, অনন্তকাল। তাঁকে অশেষ শ্রদ্ধা। তিনি ছিলেন সুফিয়া কামালের উত্তরসূরী। সুফিয়া কামালের অস্ত্র ছিল কালি আর কলম। তিনি মুক্তিকামী মানুষের আন্দলনে থেকে এবং নিজের কবিতায় লেখায় সেই মানুষের কথা লিখেই সুফিয়া কামাল হয়ে উঠেছিলেন জননী সাহসিকা। আজকের দিনে বাংলা সাহিত্যের এবং নারী স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক হিসাবে রাবেয়া খাতুন, নাসরিন জাহান, শাহীন আখতার, পূরবী বসু, সেলিনা হোসেন এবং রিজিয়া রহমান এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এই কথা সাহিত্যিকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, বিক্রমপুরের পাউসার গ্রামে মামার বাড়িতে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই সম্পাদক ও চিত্র পরিচালক এটিএম ফজলুল হকের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। চার সন্তানের জননী রাবেয়া খাতুন।

উনাকে আবার রত্নগর্ভা বললে ভুল হবে না। ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী। উনার চার সন্তান নিজের গুণে গুণান্বিত।

রাবেয়া খাতুন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে যেতে পারেননি। নিজের চেষ্টায় অনেকটা নিজের স্বাধীনতা নিয়ে বেড়ে উঠা তৎকালীন মুসলিম সমাজের একজন নারী হিসাবে শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ করেছেন বেশ আগ্রহ নিয়ে। লেখা লেখির পাশাপাশি ভ্রমণে ছিল বেশ আগ্রহ। অনেক দেশে ঘুরেছেন তিনি। টরেন্টো ইউনিভাসিটি বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে কানাডা ঘুরে এসেছিলেন। বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যের অন্যতম লেখক তিনি।
কথা সাহিত্যিকের এই নক্ষত্র লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি ঔপন্যাসিক হলে সাহিত্যের সব শাখায় ছিলেন তাঁর অবাধ বিচরণ।

তাঁর গল্প-উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সমাজ-সংস্কৃতি মানবতা এবং মূল্যবোধ। শিশু একাডেমি বই থেকে প্রকাশিত আলোচিত গন্থ ’সুমন ও মিঠুর গল্প’। তাঁর ৫০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ছোট গল্প এক হাজারের ও অধিক।

২০০৪ সালে বিখ্যাত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেঘের পরে মেঘ’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং ২০১১ সালে তাঁর আরেকটি জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মধুমতি’ অবলম্বনে নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র।

উনার চিন্তাধারার শেখর গভীরে। সমাজকে সুশিক্ষিত করতে হলে নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। কাজ করেছেন নারীদের নিয়ে। উনি গল্পের মাঝে নিয়ে এসেছেন নারীর মুক্তির পথ। নারী নির্যাতনের উপর উনার প্রথম গল্পের যাত্রা ‘প্রশ্ন’ প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক যুগের দাবিতে ১৯৫৯ সালে।

প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতী’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এটি এদেশের ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনের দলিল, যা এদেশের উপন্যাসে প্রথমবারের মতো উঠে আসে। তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে অনন্ত অন্বেষা (১৯৬৭), মন এক শ্বেত কপোতী (১৯৬৭), রাজাবাগ শালিমারবাগ (১৯৬৯), সাহেব বাজার (১৯৬৯), ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), নীল নিশীথ (১৯৮৩), বায়ান্ন গলির এক গলি (১৯৮৪), মোহর আলী (১৯৮৫), ই ভরা বাদর মাহ ভাদর (১৯৮৮), বাগানের নাম মালনিছড়া (১৯৯৫)। শিশুতোষ ও ভ্রমণ সাহিত্যেও তিনি রেখেছেন সৃজনশীলতার ছাপ। তাঁর গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র। তিনি নিজেও বেতার ও টিভির জন্য অনেক নাটক লিখেছেন।

বাংলা সাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার এবং সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), একুশে পদক (১৯৯৩), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), শের-ই-বাংলা স্বর্ণ পদক (১৯৯৬), নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯), ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩), সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭)।

তাঁর সময়ে মুসলিম নারী লেখক তেমন ছিলেন না। শুরু থেকে সহযাত্রী ছিলেন কায়ুম চৌধুরী, মির্জা আবুল হাই, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আহসান হাবীব, আবুল কালাম, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ।

তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা, নারীদের শক্তি এবং সাহস। রাবেয়া খাতুনের সৃষ্টিকে অমর করে রাখতে ‘রাবেয়া খাতুন স্মৃতিপরিষদের’ অর্থায়নে বাংলা একাডেমি ২০২২ সাল থেকে প্রবর্তন করেছে ‘রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কার’। প্রতি বছর বাংলাদেশের দুজন কথাসাহিত্যিককে এই পুরুস্কার দেওয়া হয়। সাহিত্যের অবদান এবং সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠক এবং ভক্তের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন সাহিত্যের নক্ষত্র রাবেয়া খাতুন।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।