সেদিন ধানমণ্ডি ৩২-এ গিয়েছিলাম ঝাপসা চোখে, কাঁপা শরীরে

বিশ্বে যে’কটি ঐতিহাসিক বাড়ি আছে, তার মধ্যে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিই আমারে চোখে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। বাড়িটিতে একসময় সব ছিল। বাড়ির কর্তা ছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীদের অন্যতম, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, যার একটি অঙ্গুলি হেলনে পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, সেই মহাপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সাজানো, গোছানো পরিপাটি সংসারে সবই ছিল। মহান স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সকল আন্দোলনের সূঁতিকাগার এটি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন কালেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি বাড়িতে ওঠেননি। ঐতিহাসিক ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিই ছিল সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। বাংলার কুলাঙ্গার আর মীরজাফররা এক রাতে ফুলে-ফলে ভরা বাগানকে ধ্বংস করে দেয়ার সাক্ষী এটি।

আমি গিয়েছিলাম ইতিহাসের সাক্ষী হতে। সামান্য পরিমাণ বাঙালিয়ানা যার আছে, অবশ্যই সেখানে গিয়ে একবার মাথা নত করবেই। বঙ্গবন্ধু নামের মানুষটির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর অপরিসীম ভালবাসার টানে ছুটে যাবে সেখানে। একজন বাঙালির যদি একটি হৃদয় থাকে তাহলে ধানমণ্ডির ৩২ এ গিয়ে সে নিজেকে স্থির রাখতে পারবে না। কিছুতেই না!

২০১৮ সালে জীবনে প্রথমবারের মতো রাজধানী ঢাকা ও দক্ষিণবঙ্গ ভ্রমণের সুযোগে অতৃপ্ত ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল ঐতিহাসিক ধানমণ্ডি ৩২Ñএ যাওয়ার। সেই অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।

রিকশা থেকে নেমে আস্তে আস্তে যখন পা ফেলছি, চোখ ঝাপসা হয়ে চশমার কাঁচগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল বারবার। যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম পা জড়িয়ে যাচ্ছিল। একদিন এখানেই তো ছিল কোলাহল আর আনন্দ। আজ সময়ের বিবর্তনে সব স্মৃতি! ৫ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে নিজেকে বলছি, আমি কী ঢুকব? সেই সাহস কী আমার হবে? নিজেকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে এগোলাম। তিন তলা বাড়ির ভবনে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়ল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বলা যায়, এক তলার প্রথম কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তোলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এ তলায় আরও আছে পরিবারের নিহত অন্য সদস্যদের তৈলচিত্র। দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ।

১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, জামাল, কামাল, রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে পড়েছিল। আর এ ঘরের সামনে করিডোর থেকে নিচে যাওয়ার জন্য যে সিঁড়ি সেখানেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান বঙ্গবন্ধু। এখনো গুলির স্পষ্ট চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। সিঁড়িটি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। সিঁড়ির গোড়ায় হাত দিতেই দুচোখ বেয়ে অনবরত অশ্রু টলটল করে দু-চোখে। একটা সময় স্থির থাকতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলি। আশেপাশের দর্শনার্থীরা আমার দিকে ফেলফেল তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ এখানে নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে সামনের দিকে এগুতে থাকি। সামনেই বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তাঁর সবসময়ের সঙ্গী পাইপ, তামাকের কৌটা। এ কক্ষে আরও আছে টেলিফোন সেট, রেডিও। কিছু রক্তমাখা পোশাক। বঙ্গমাতার নিজ হাতে বানানো আচার আজো বৈয়ামে রাখা।

সামনের খাবার ঘরের পাশেই আছে শিশু রাসেলের ব্যবহার করা বাইসাইকেল। জং ধরেছে ঠিক, চিরচেনা রূপে আছে আজো। সাইকেলের দিকে তাকাতেই চোখে ভাসছিল রাসেল ভাই মনে হয় উপরে বসে আছে আর আমাকে দেখে সেই মনভোলানো হাসি হাসছে। উল্টো দিকে শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় সেনাবাহিনীর সামরিক পোশাক। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা হাসিনা, বোন শেখ রেহানার কক্ষও একই তলায়। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। দেয়ালে বড় করে টাঙানো আছে শেখ কামাল, সুলতানা কামালের বিয়ের ছবি। জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দুজনের। এ কক্ষে তার বিভিন্ন সংগীতযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। বাড়ির রান্নাঘরের হাঁড়িগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো। এ ভবনের মোট নয়টি কক্ষে বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে আরও আছে বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশুপুত্র রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবহার্য আসবাবের মধ্যে আরো আছে খাবার টেবিল, টেবিলের ওপর থালা, বাটি। আছে সোফা।

প্রতিটা অমূল্য জিনিসপত্র সেভাবেই সাজানো আছে। সেই মহামূল্যবান মানুষগুলো এক রাতের নির্মমতায় নেই হয়ে গেছে। বাড়ির দেয়াল, দরজায় বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বীভৎসতা স্মরণ করিয়ে দেয়। বেরিয়ে আসার সময় বাঁধভাঙা চোখের জল আরও সমুদ্র হয়ে বয়ে যাচ্ছিল ধানমণ্ডির রাজপথে। ভুলেই গেছিলাম সেখানে রাখা স্মারক বইয়ে অভিজ্ঞতার কথা লিখতে। ৩২ নম্বরের বাড়িটি সব ভুলিয়ে দিয়েছিল আমায়। ভেতরে ছবি তোলার অনুমতি দেয়না বলে চিত্র ধারণ করতে পারিনি। মোবাইলে ধারণ করতে না পারলেও হৃদয়ের ক্যানভাসে সব ছবি আঁকা হয়ে গেছে।

১৫ আগষ্টের কালরাত্রির খলনায়ক, কুলাঙ্গার, স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রেতাত্মারা সারাজীবন ঘৃণার পাত্র পৃথিবীতে। অন্যদিকে জাতির পিতা, শহীদ পরিবারের সবাই মরেও অমর থাকবে যতদিন ৬১ হাজার বর্গমাইলের নদীগুলো বয়ে যাবে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক