অবশেষে স্বর্ণ ‘চোরাকারবারি’ চট্টগ্রামের আবু আহমদকে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে হাইকোর্ট।
রোববার (৮ জানুয়ারি) দুপুরে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ এ সংক্রান্ত একটি আদেশ দেন।
প্রকাশ্যে প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণ চোরাকারবারের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা এই আবু আহমদ ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিদেশে গড়েছেন অর্থনৈতিক অপরাধের অন্তর্জাল। অনুসন্ধান শেষে তার বিরুদ্ধে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
আবু আহমদ ফটিকছড়ির জাফতনগর এলাকার ফয়েজ আহম্মদ ওরফে বালী সওদাগরের ছেলে।
২০২০ সালের ১৮ মার্চ সিআইডি’র উপপুলিশ পরিদর্শক মো. হারুন উর রশীদ আবু আহমদ ওরফে আবুসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন থানায় স্বর্ণ চোরাচালান, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বিভিন্ন নামে ব্যাংকে একাউন্ট (হিসাব) খুলে আসামিরা সংঘবদ্ধ হুন্ডি (অর্থ পাচার), সোনা চোরাচালান, চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসার সর্বমোট ২০৪ কোটি ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮৮৭ টাকা জমা এবং এর মধ্যে ২৪০ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ১৬০ টাকা উত্তোলন করে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন আবু আহমদ।
রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক জানান, গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আগাম জামিন চান আবু আহম্মদ। হাইকোর্ট তাকে জামিন না দিয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরে ২২ ফেব্রুয়ারি আবু আহম্মদ আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। ওইদিন চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত মামলার নথি তলব করে ৫ মে আবেদনটি শুনানির জন্য রাখেন। কিন্তু চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত থেকে নথি না আসায় ১৩ জুলাই জামিন আবেদনের শুনানি রাখেন। ওই তারিখেও নথি না আসায় ৩১ আগস্ট নথি উপস্থাপন করতে বলে আদালত ৫ সেপ্টেম্বর জামিন আবেদনের শুনানির তারিখ ধার্য করেন।
পরে নথি আসলেও আবু আহমদ সময় আবেদন করলে জামিন আবেদনের শুনানি আরও কয়েকবার পেছানো হয়। গত ১৩ নভেম্বর জামিন আবেদনের শুনানির দিন আবু আহমদ ফের সময় আবেদন করলে তা না মঞ্জুর করে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এরপর আসামি আবু আহমদ হাইকোর্টে হাজির হয়ে আগাম জামিন আবেদন করেন। গত ৫ ডিসেম্বর আগাম জামিনের আবেদনের শুনানি শেষে আদালত ৬ ডিসেম্বর আদেশের জন্য রাখেন।
গত ৬ ডিসেম্বর আসামি হাজির না হলে আবু আহমদের আইনজীবী আগাম জামিনের আবেদনটি ‘নট প্রেসড’ (উত্থাপিত হয়নি বলে খারিজ) করতে চাইলে আইনজীবী ফারিয়া বিনতে আলমের প্রতি আদালত উষ্মা প্রকাশ করে ‘নট প্রেস’ না করে আসামিকে গ্রেফতার ও তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
এরপর তাকে যে কোনো মূল্যে গ্রেফতার করে যথাযথ আদালতে হাজির করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিও নির্দেশ দেন। পরদিন এ মামলার তদবিরকারককে তলব করেন হাইকোর্ট। হাজিরের পর ১২ ডিসেম্বর তদবিরকারক নুর মোহাম্মদ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করলে আদালত আসামিকে কোর্টে হাজির করার জন্য তদবিরকারককে নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে আসামির বিরুদ্ধে হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করায় রুল জারি করেন আদালত।
এদিকে আবু আহমদকে গ্রেফতারের বিষয়ে চট্টগ্রাম পুলিশ সুপারকে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন। পরবর্তী আদেশের জন্য চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দিন রাখেন। নির্দেশ অনুযায়ী তদবিরকারক নুর মোহাম্মদ স্বর্ণ চোরাকারবারী আবু আহমদকে আজ রোববার দুপুরে হাইকোর্টে হাজির করলে তাকে শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
সিআইডি সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার হয় ১০৫ কেজি স্বর্ণ। একই বছর ৬১ কেজি স্বর্ণ মেলে ঢাকার পল্টনে। ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে ২৯ কেজি স্বর্ণের চালান জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব সোনা চালানের সঙ্গে গডফাদার হিসেবে নাম আসে আবু আহামদের।
সিআইডির ইকোনোমিক ক্রাইম স্কোয়াড বলছে, প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসাই আবুর একমাত্র বৈধ আয়ের উৎস। এক দশক আগে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে হুন্ডি ও বিভিন্ন ধরনের চোরাই মালের ব্যবসায়ও হয়ে ওঠেন সিদ্ধহস্ত। বিভিন্ন ব্যাংকে আবু আহমদের ২১টি হিসাব পর্যালোচনা করে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পায় ইকোনোমিক ক্রাইম স্কোয়াড। এসব টাকায় আবু চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ২৪টি জমি, শহরে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি কিনেন। আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশে গড়েছেন বিপুল সম্পদ।