প্রথমত বলে রাখা ভালো যে, প্রাইভেট প্র্যাকটিস এর বিরুদ্ধে আমরা আপাতত কেউ নই। কেননা চিকিৎসকদের নন- প্র্যাকটিসিং ভাতা বা সন্মানী না দিয়ে কোথাও প্র্যাকটিস বন্ধ করার নিয়ম নেই। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট সেবা কথাটা বড়ই বেমানান। পৃথিবীর কোন দেশে এটি আছে কিনা আমাদের জানা নেই। পৃথিবীর কোন দেশে থাকলেই যে এটা গ্রহণযোগ্য সেটা আলাদা বিতর্ক। কিন্তু আমরা যেহেতু বিদেশি উদাহরণ কে টেনে আনি সেজন্য বিদেশের প্রসঙ্গ টা আনলাম । এখন আমরা কোন প্রেক্ষিতে সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু করলাম?
বিষয়টা এমন যে, ডাক্তাররা বিকেলে/সন্ধ্যায় হাসপাতালে চেম্বার করলে রোগীরা উপকৃত হবেন? এটার কি কোন জনমত আছে? না । কেবল একটা ধৎনরঃৎধৎু পদ্ধতি তে এটি চালু করা।
না কোন জনমত, না কোন বিশেষজ্ঞ কমিটি, না কোন সার্ভে – কিছু ই না করে কেবল টেবিল টকের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রী ঘোষণা দিলেন আর অমনি পাইলট প্রকল্পের নামে- সরকারি কিছু টাকা পয়সা খরচ করে, অবকাঠামো নির্মাণের নামে, এ রকম একটা সেনসিটিভ কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। দেশের প্রায় ১০ জেলা আর ৩০ এর অধিক উপজেলায়। যে কোন মৌলিক বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা দরকার। দেশের রিটায়ার্ড প্রফেশনালদের সাথে এবং সকল চিকিৎসক সংগঠনগুলোর সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে, সকল মতামত নিয়ে তারপর হয়তো পাইলট প্রকল্প নেয়া যায়। সেটা অন্য দশটা সাধারণ সেক্টরে করা যায়।
কিন্তু জীবন মরণের প্রশ্ন যেখানে জড়িয়ে আছে ওসব ক্ষেত্রে পপুলার সিদ্ধান্ত না নেয়াই উত্তম। সবচেয়ে বড় কথা হলো- সরকারি খরচে কমপক্ষে দুই শিফট চালু করা ছিল জনমুখী পদক্ষেপ। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যদি প্রাইভেটাইজেশনকে উৎসাহিত করা হয় তবে যেটুকু সরকারি সুবিধা
জনগণ এখনো পাচ্ছে সেটা দিন দিন আরো অবহেলিত হবে। ফলে সকাল বেলার প্রায় রোগী বাধ্য হবে প্রাইভেট চেম্বারমুখি হতে। এতে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যয় বেড়ে যাবে। এমনিতেই একটা অভিযোগ দীর্ঘদিনের যে, রোগীদেরকে চিকিৎসকরা ব্যাক্তিগত চেম্বারে বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে যান। এখন সেটি সরকার নিজে আরো সহজ করে দিল কিম্বা এক প্রকার স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে দিল।
যেসব চিকিৎসক এখনো আন্তরিক ছিলেন তারাও ব্যবসায় একে অন্যের প্রতিযোগী হয়ে ওঠবেন। ফলে সরকারি হাসপাতালের সেবায় আরও হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হবে। কোন ভাবেই সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চর্চা করতে দেয়া উচিত হয়নি। বরং বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও জনবল নিয়োগসহ নানা সুবিধা বাড়ানো একটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তার কাজ চাকুরীজীবিদের ব্যাক্তিগত লাভের সুযোগ তৈরি করা নয়।
রোগীর সেবা সার্বক্ষণিক নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। টাকা থাক আর না থাক সবাই যেন সেবা পায় সেটা দেখা হলো সরকারি কাজ।
২. এখন আসি ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের বিষয়ে-
এটি হতে পারে বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোয়। যেমন বারডেম বা বেসরকারি হাসপাতালে। মোটকথা, সরকারি আর বেসরকারি হাসপাতাল সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে। যদিও বা স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ নিয়ে আমার ভিন্ন মত আছে।
কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতার দোহাই দিলেও কোন ভাবে এটি ভালো ফলাফল আনবে না। বরং যেটুকু সেবা গরীব রোগীরা এতদিন পেত তার পুরোটাই কিনতে বাধ্য হবে।
৩. কি করা উচিত?
আমরা যদি সত্যিকার অর্থে মিন করি যে সাধারণ জনগণকে একটা ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবা দেব, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি করে প্রতিটি
সরকারি হাসপাতালে তিন শিফট চালু করতে হবে। তখন আর কোন চিকিৎসককে বেকার থাকতে হবে না। জনগণ ও সারাক্ষণ সমান সেবা পাবে।
অর্থনৈতিকভাবে ও স্বাস্থ্যখাত জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। যেহেতু আমরা বলি এবং তা বাস্তব বলেই বিশ্বস করি যে ‘মানব সম্পদ উন্নয়নই আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল সূচক’।
প্রতিটি বাজেট বক্তব্য শুরুই হয় উপরোক্ত বাক্য দিয়ে। কাজেই অধিক সংখ্যক চিকিৎসকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন- দুটো বিষয় যুগান্তকারী ঘটনার উদাহরণ হয়ে থাকবে।
৪. স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি না করলে কোন পদ্ধতি ফলপ্রসূ হবে না বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেট জিডিপির যাত্র ২.৩৪%। এশিয়ায় গড় বাজেট জিডিপির অনুপাতে ৫.১%।বার্ষিক বরাদ্দ মোট বাজেটের শতকরা ৫% এর কাছাকাছি। এটি হওয়া উচিত জিডিপির ৫% এর কাছাকাছি। আমরা ইউরোপ আমেরিকার কথা বাদই দিলাম। পাশের দেশ ভুটানের বরাদ্দ মাথা পিছু ১০৩ ডলার। আর আমাদের হলো ৪৫ ডলার। এমনকি পিছিয়ে দেশ আফগানিস্তানের চেয়েও আমাদের মাথা পিছু বরাদ্দ কম। আফগানিস্তানের ৫০ ডলার, আমাদের দেশে বার্ষিক বরাদ্দ জনপ্রতি যেমাট ৪৬৩৫ টাকা। মাসিক ৩৮৬.২৫ টাকা। ভাবা যায় এই টাকায় জনগণ কোন মানের স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে?
অথচ ঔষধ পথ্য থেকে শুরু করে সব কিছুর আলটিমেটলি দায় বর্তায় চিকিৎসকের ওপর। সাধারণ মানুষের হিসাবটা এ রকমের। তারমানে চিকিৎসক এবং জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই অপ্রতুল বাজেট।
কাজেই দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাজেট বৃদ্ধি না করে কেবল সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চর্চা করে দেওয়াই সঠিক সমাধান নয়। এটি পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাবে। সরকারি হাসপাতাল হয়ে ওঠবে পুরো মাত্রায় একটা স্বঘোষিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
অতএব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কতৃক গৃহীত সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত বাতিল করে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল স্বাতন্ত্র্য পরিচালনার যুগোপযোগী এবং জনবান্ধব ব্যবস্থাপনা নিন।
লেখক : সদস্য সচিব
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি, চট্টগ্রাম।