বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে আলোচিত একটি দেশ। দেশের সবকিছুতে বিদেশিদের দৃষ্টি পড়েছে । ভূরাজনৈতিক কারণেও প্রতিবেশি কিংবা দূরদেশি বন্ধুরা যেনো দূরবীণ তাক করে আছে। কখন কি ঘটছে। কোনো কিছুই এড়াচ্ছে না তোদের চোখ থেকে। চলতি বছর শেষে কিংবা আগামী জানুয়ারির শুরুতেই দেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনেও দেশি বিদেশি নানা মহলের নানা মিশন। একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় নির্বাচন হবে তা নিয়ে দেশের মানুষের না যত আগ্রহ ইচ্ছা তার চেয়ে বেশি বিদেশিদের ভাবনা চিন্তা। কিন্তু নির্বাচনে যারা মূল ভূমিকায় থাকবে তাদের মুখে সেই সুর নেই। এর মধ্যে গতকাল শনিবার রাতেই দেশে এসে পৌছেছে ইইউ’র ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। তারা নির্বাচনের প্রস্তুুতি এবং পর্যবেক্ষক পাঠানোর উপযোগিতা যাচাই করবেন।
নির্বাচনে প্রধান প্রতিপক্ষ সরকারী দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। তারা এখনো দুই মেরুতে। সরকারী দলের প্রধান শর্ত বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। বিরোধী দল হাঁটছে তার উল্টো। তাদের দাবি বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচন দিতে হবে। এই দুই দলের দুই শর্ত নিয়ে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ প্রতিনিধিরা দফায় দফায় বৈঠক করে আসছেন। কিন্তু দুই দলই এখনো অনড় অবস্থানে। এ পরিস্থিতিতে সংলাপের প্রস্তাব করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। একই মতে আছে ভারত ও চীন। কিন্তু ইইউ ও মার্কিনীদের তৎপরতাকে নব্য ঔপনিবেশিকতার নগ্ন হস্তক্ষেপ উল্লেখ করেছে রাশিয়া। বিদেশিদের এসব মিশনে শেষ পর্যন্ত সংলাপ কি চেহারা নেয় তা কেউ বলতে পারছে না। একই ভাবে দুই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলও রাজি হবেন কি না সেই সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এতে করে সংলাপ এখন সম্ভব অসম্ভবের দোলাচলে দুলছে দখিনা হাওয়ায়। তবে কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে ছোট্ট দেশটির মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ,পদ্মাসেতু,বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেলের উপর।
এদিকে গতকাল শনিবার সকালে ডিআরইউ’তে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট শীর্ষক আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, তাদেরকে বিশ্বাস করে আগেও সংলাপ করেছি, প্রতারিত হয়েছি। এখন প্রশ্নই আসে না। স্যাংশন, ভিসা নীতিসহ আরও নানা কারণে বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তি এখন তলানিতে। রোল মডেল নয়, গোল মডেল বানিয়েছে। দেশকে ফতুর করে দিয়েছে সরকার।
এদিকে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন। তবে এজন্য সব দলমতের অংশগ্রহণ, ইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি থাকা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘আগামীতে আমরা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন করব। এই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত কয়েক বছরে অনেক নির্বাচন হয়েছে। দুয়েকটি বাদে সবকটি স্বচ্ছ হয়েছে। ভবিষ্যতেও আমরা স্বচ্ছ নির্বাচন করব। তবে স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সব দলমতের ইচ্ছা এবং প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।’
গতকাল শনিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ডিক্যাব টকে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলে ধরে আবদুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য না বললেও লোকজন এখানে আসছে। এখন সব দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহী। দেখেন কত দেশ আসছে। আমরা না ডাকতেও আসছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভাবমূতির পরিবর্তন হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি এখন ল্যান্ড অব অপরচুনিটি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে প্রথম। এজন্য অনেকেই আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। সব সম্ভব হয়েছে স্থিতিশীল সরকার থাকায়। এটি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে নির্বাচনী ইস্যূ নেই বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধানমন্ত্রী বা সংসদের পদত্যাগ এই তিন বিষয় তাঁদের সঙ্গে হওয়া বৈঠকের এজেন্ডাতে নেই। মার্কিন প্রতিনিধিদল এসেছে নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে নয়, তারা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি জানতে এসেছে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে আগমন সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ইইউ প্রতিনিধিদল এসেছে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল কীভাবে পর্যবেক্ষণ করবে তা দেখতে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, সরকার যেমন আছে তেমনই থাকবে। একটা ঢেউও তো জাগাতে পারেনি। তাদের আন্দোলনে নেতা কে? ক্যাপ্টেন ছাড়া কি জাহাজ চলবে? এই জগাখিচুড়ি ঐক্যে দফায় দফায় পরিবর্তন। এই ৩২ দল টিকবে কি না, তার গ্যারান্টি নেই। আগে তো ছিল ৫৪ দল। এই জগাখিচুড়ি ঐক্যের পতন অনিবার্য।
তবে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, সংবিধান মোতাবেক নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে বিরোধীদের সঙ্গে সংলাপ হবে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো সংলাপ হবে না। কারণ, উচ্চ আদালত এটা বাতিল করেছে। গত ৫ জুলাই বুধবার ঢাকায় যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী নাইজেল হাডলস্টনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের সামনে এসব কথা বলেন তিনি।
সালমান এফ রহমান বলেন, ‘ইউ কে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আমরাও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনে কমিটেড। আমাদের ইসি স্বাধীন। অনেক সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিরপেক্ষ হচ্ছে, এটা তার প্রমাণ। সংবিধান মেনেই নির্বাচন হবে এই দাবি তারা (বিএনপি) মেনে নিয়ে সংলাপে আসলে আমরা সংলাপে রাজি।’
প্রসঙ্গত, সরেজমিনে বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ তথা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুসন্ধানী অগ্রগামী দলের সদস্যরা ঢাকায় পৌছে গেছে। জানা গেছে আজ রোববার থেকে ইইউ টিমের দুই সপ্তাহব্যাপী ঢাকা মিশন শুরু হবে। মিশনের মূল কাজ হবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পরিবেশ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক টিম পাঠালে তার কর্মপরিধি কি হবে, বাজেট, লজিস্টিক্স ও নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় নির্বাচন কমিশন কতোটা ফ্যাসিলিটেড করবে তার আগাম মূল্যায়ন করা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে গত বৃহস্পতিবার জানানো হয়, নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে ইইউ’র অনুসন্ধানী মিশন বাংলাদেশে আসছে। এখানে অবস্থানকালে টিমটি সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবে। উল্লেখ্য, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও সব অংশীজনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সদস্যদেশগুলো নিবিড়ভাবে কাজ করছে। ইইউ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চা এবং সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল স্লোভাকিয়ার প্রতিনিধিত্বকারী ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ইভান স্টিফেনেককে লেখা এক ফিরতি চিঠিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছেন। সেখানে তিনি ওই নির্বাচনে সব অংশীজনের ভূমিকা চেয়ে বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা সৃষ্টির জন্য সব অংশীজনকে ভূমিকা রাখতে হবে। আর সেজন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপ এবং নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের কথা উল্লেখ করে ইইউর পররাষ্ট্রনীতিপ্রধান বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতাসহ মৌলিক স্বাধীনতাগুলোর সুরক্ষা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। যে কোন ধরণের সহিংসতার নিন্দা করে ইইউর জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি বলেন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল্যবোধ ও নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই এ বিষয়গুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে নিয়মিতভাবে উত্থাপন করে থাকে।
এমএইচএফ