লাল সংকেত মানে সব কিছু বন্ধ। পরিবেশ অধিদপ্তরের এমনই লাল এক নোটিশে সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের সমস্ত কাজ থামিয়ে দিয়েছে। ফলে এই শিল্পের মালিকদের প্রতিমাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে মাসে শত কোটি টাকা। চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডে দক্ষিনাঞ্চলে গড়ে উঠা মেয়াদ উত্তীর্ন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকে কমলা থেকে লাল শ্রেনী তালিকাভূক্ত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
জানা গেছে, পরিবেশের সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী লাল তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাক্ষর করা দুই দফা ছাড়পত্র নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর আগে কমলা তালিকাভূক্ত থাকায় চট্টগ্রাম থেকে একবার ছাড়পত্র নিয়েই জাহাজ ভাঙ্গা সম্পন্ন করা যেতো।
লাল তালিকাভূক্ত করায় ঢাকা আসা যাওয়া নানান জটিলতায় একটি জাহাজ ইয়ার্ডে ভীড়ার পর প্রায় দুই মাসের অধিক সময় লেগে যায় এটি ভাঙ্গার কাজ শুরু করতে। ফলে ব্যাংকের লোন নিয়ে আনা সুদের বোঝা বইতে গিয়ে ইয়ার্ড মালিকদের কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। প্রতিটি জাহাজের জন্য দৈনিক ৪ থেকে ১০ লাখ টাকা সুদ গুনতে হচ্ছে। জাহাজ কাটা শিল্পের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিএ) এর সহ- সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন চৌধুরী দেশ বর্তমানকে বলেন, চলতি বছরে এ যাবৎ প্রায় ৮১ টির মতো জাহাজ আমদামী করা হয়েছে। লাল তালিকাভূক্ত হওয়ার আগে প্রায় ৩৯ টি জাহাজ কাঁটা হয়। বাকি ৪২ টি জাহাজ পরিবেশ অধিদপ্তরের লাল তালিকাভূক্ত আওতায় পড়ে যাওয়ায় এগুলো ভাঙ্গার কাজ থমকে যায়।
ফলে এসব জাহাজ আমদামীর প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা লোনের জন্য সুদ গুনতে হচ্ছে দৈনিক সোয়া চার কোটি টাকা। লাল তালিকা বাতিল করা না হরে এবং এই নিয়ম চলতে থাকলে শিপ ইয়ার্ডগুলো বন্ধ করে দেয়া ছাড়া অন্য কোন পথ থাকবে না। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে দেশের কয়েক শত রি- রোলিং মিল, হাজারো বড় ছোটখাত কোটি টাকার লোহা-লক্করের দোকান,ইলেক্ট্রনিক, স্যানিটারী,ফার্নিসার্স, হার্ডওয়্যার, অক্সিজেন প্যান ব্যাবসাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। জাহাজ ভাঙ্গা বন্ধ হলে এসব হাজারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তিনি লাল তালিকা প্রত্যাহার করে কমলা তালিকা বলবৎ রাখার জন্য জোড় দাবী জানান।
বিএসবিএ এর সভাপতি মোঃ আবু তাহের দেশ বর্তমান প্রতিনিধিকে জানান, ‘জাহাজ ভাঙ্গার অনুমোদন পত্র প্রদান করতেন চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর। যেহেতু জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে, তাই চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরই আমাদের জন্য সুবিধাজনক। তাছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্যও এটি সুবিধাজনক, তারা প্রয়োজনে যেকোন সময়ে ইয়ার্ড পরিদর্শনে আসা যাওয়া করতে পারবেন।
অথচ গত মার্চ মাসে হঠাৎ এক নোটিশের মাধ্যমে পরিবেশ অধিদপ্তর এই শিল্পকে লাল (৭২ নং) তালিকাভুক্ত করে। এতে যেমন চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর জাহাজ ভাঙ্গা ছাড়পত্র প্রদানে ক্ষমতা হারায়, অপরদিকে ঢাকা থেকে দুই তিন দফায় ছাড়পত্র নিতে গিয়ে জাহাজ ভাঙ্গার কাজও থমকে যায়।
সভাপতি আবু তাহের জানান, একদিকে ইয়ার্ড মালিকদের প্রতিটি জাহাজের জন্য দৈনিক চার থেকে দশ লক্ষ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে, অপর দিকে এই পদক্ষেপের কারণে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় ২৪/২৫ হাজার জাহাজভাঙ্গা শ্রমিক। তিনি অবিলম্বে এই লাল তালিকা প্রত্যাহারের দাবী জানান।
এস এল ষ্টীল শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের কর্ণধার আলহাজ্ব মোঃ লোকমান দেশ বর্তমানকে জানান, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে আগে প্রায় দেড় শতাধিক ইয়ার্ড ছিল, নানান কারণে বাজারে টিকে থাকতে না পেরে প্রায় শতাধিক ইয়ার্ড মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। তারা অনেকেই ব্যাংকের লোন ও সুদে দেউলিয়াও হয়ে গেছেন। এরই মধ্যে করোনা মহামারি দেখা দিলে অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প মারাত্মকভাবে লোকসানের সম্মুখীন হয়।
দীর্ঘ সময় ইয়ার্ড বন্ধ থাকায়, উত্তর বঙ্গের শ্রমিকরা গ্রামের বাড়ী-ঘরে চলে যায়। ফলে জাহাজ মালিকদের অগ্রিম দেয়া লক্ষ লক্ষ টাকা হারাতে হয়। সাথে ব্যাংকের এলসি লোনের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। এরপর শুরু হলো ডলার সংকট। এলসি খুলতে না পেরে জাহাজ আমদামী করা যায়নি। ফলে ইয়ার্ড বন্ধে কারনে শ্রমিক-কর্মচারির খরচ,ব্যাংকের বকেয়া লোনের সুদ প্রদান,এসব বহন করতে গিয়ে ইয়ার্ড ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।
আলহাজ্ব লোকমান বলেন,‘চলতি বছরে জাহাজ ভাঙ্গা একটু আলোর মুখ দেখতে না দেখতেই লাল তালিকাভূক্তির নোটিশ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই দিকে শিপইয়ার্ডগুলো বন্ধ থাকায় দেশের প্রায় চার শতাধিক ম্যানুয়েল রি- রোলিং মিল প্রায় বন্ধের পথে। তাছাড়া পুরাতন জাহাজের বিভিন্ন মালামাল যেগুলো দেশের হাজারো প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রেখেছে, সেসব ব্যবসায় জড়িত দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েক লক্ষ ব্যবসায়ীও চরম ক্ষতির শিকার হবেন।’
তিনি লাল তালিকা প্রত্যাহার করে পূর্বের কমলা তালিকা বলবৎ ও চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরকে আগের ন্যায় ক্ষমতা প্রদানের দাবী জানান। তাছাড়া ডলার সংকট সহ বিভিন্ন সমস্যায় ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না,ফলে ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে।
ভাটিয়ারী শিপ ইযার্ডের কর্ণধার মোঃ নাঈম এই প্রতিবেদককে জানায়,‘সরকার ২০২১ সালে শিপ ইয়ার্ডকে শিল্প তালিকাভূক্ত ঘোষনা করে। মালিক পক্ষ উৎসাহিত হয়ে তাদের নিজেদের ইয়ার্ডগুলো পরিবেশ বান্ধব গড়ে তোলতে কাজ করে যাচ্ছে,ইতিমধ্যে আটটি ইয়ার্ড গ্রীন শিপ ইয়ার্ডে রুপান্তিত হয়েছে, চলতি বছরের ২১ মে শওকত আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন শীতলপুরস্হ এস এন গ্রীন করপোরেশনের ইয়ার্ডে জাপানী ক্লাক এনকের সংস্থার ১৫ সদস্য একটি পরিবেশ বাদী টিম পরিদর্শন করেন।
তারা সন্তোষ প্রকাশ করে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক শওকত আলী চৌধুরীকে” নিপ্পন কাজি কিয়োকাই ” আন্তর্জাতিক সনদ প্রদান করেন। যেহেতো ইয়ার্ডগুলো পরিবেশ বান্ধব হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে, তাই প্রতিটি মালিককে ব্যবসা চালিয়ে রেখে সেগুলি গ্রীন ইয়ার্ড হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে। নতুন লাল তালিকাভুক্তি এটাকে বাধাগ্রস্থ করবে। তিনিও কমলা তালিকাভূক্ত বলবৎ রেখে পূর্বের ন্যায় চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর কে সনদ প্রদানে ক্ষমতায়ন করার দাবী জানান।
এ প্রসঙ্গে এসএন গ্রীণ করপোরেশনের মালিক শওকত আলী জাহাঙ্গীর চৌধুরী দেশ বর্তমানকে বলেন, কোবিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘদিন ইয়ার্ডগুলো বন্ধ থাকার পর পরই দেখা দিয়েছে ডলার সংকট। এলসি খুলতে না পেরে প্রায় শতাধিক ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যায়। অনেক মালিক দেউলিয়াও হয়।বিএসবিএ অন্যতম সদস্য ও ব্রাদার ষ্টীল ও শিপ ইয়ার্ডে কর্ণধার এবং মিড ল্যান্ড ব্যাংকের
পরিচালক মাষ্টার আবুল কাসেম দেশ বর্তমানকে বলেন,”১৯৭৮ সালে সীতাকুণ্ডে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী শিপ ইয়ার্ড ও রিসাইক্লিন ব্যবসা গোড়াপত্তন করেন। শুরু হতে দেশী-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে এখন এ শিল্প দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ও নির্মানে সিংহভাগ লৌহইস্পাত অন্যতম যোগানদাতা। বর্তমান সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শিল্পকে অগ্রাধিকার ভিক্তিতে শিল্পী মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।
তাই তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘অচিরেই সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শিপ ইয়ার্ড আবারো কর্মচাঞ্চল্যে ভরে উঠবে। বিশ্বের দ্বিতীয় স্ক্রাপ জাহাজ বিভাজন ও রিসাইক্লিন জোন হিসেবে গড়ে উঠবে।”