রিচার্লিসন: সংসার চালিয়েছেন আইসক্রিম বেচে, থেকেছেন আধপেটা খেয়ে

বিশ্বকাপের শুরুর ম্যাচেই কাতারের মাঠে তিনি জাদু দেখিয়েছেন।  পায়ে বল নিয়ে লিখে ফেলেছেন ইতিহাস।  ব্রাজিলের রিচার্লিসনের সাইড ভলিতে অনবদ্য দ্বিতীয় গোলটির কথা রাতজাগা ফুটবলপ্রেমীরা মনে রেখে দেবেন অনেক দিন।

খেলার বয়স তখন ৭৩ মিনিট।  বক্সের মধ্যে থাকা রিচার্লিসনকে প্রায় ঘিরে রেখেছেন সার্বিয়ার তিন ফুটবলার।  বাঁ দিক থেকে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের ক্রসে বক্সের দিকে ভেসে আসা বলটা মাটিতে পড়তেই দেননি রিচার্লিসন।  প্রথম ছোঁয়ায় বলটা নিজের সামনে একটু তুলে নেন।  তার পরে অসামান্য সাইড ভলিতে জড়িয়ে দেন জালে।

বিশ্বকাপ খেলতে নেমে প্রথম ম্যাচেই রিচার্লিসনের এই গোল বুঝিয়ে দিয়েছে ব্রাজিলের ফুটবল দেখতে এখনও কেন রাতের পর রাত জেগে থাকেন ফুটবলপ্রেমীরা।  ঘটনাচক্রে, সেই ম্যাচের ৬২ মিনিটে ব্রাজিলের প্রথম গোলটিও দিয়েছিলেন তিনিই।

সার্বিয়া ম্যাচে ব্রাজিলের দুই গোলের নায়ক রিচার্লিসনের বয়স মাত্র ২৫ বছর।  ৯ নম্বর জার্সি গায়ে ব্রাজিলের হয়ে এর আগেও অনেক ফুল ফুটিয়েছেন তিনি।  চলতি মৌসুমে ৭ ম্যাচে তাঁর গোল-সংখ্যা ৯।  ব্রাজিলের কোচ বলেন, রিচার্লিসন নাকি ‘গোলের গন্ধ’ পান।  তাঁকে আটকানো কঠিন।

ব্রাজিলের এই তরুণ তুর্কি কিন্তু সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি।  বরং তাঁর ছেলেবেলা দারিদ্রে দীর্ণ।  গরিব পরিবারে চরম অর্থকষ্টের মধ্যে বেড়ে উঠতে হয়েছে ব্রাজিলের এই নতুন নায়ককে।  রিচার্লিসনের জন্ম ১৯৯৭ সালে ব্রাজিলের নোভা ভেনেসিয়া শহরে।  বাবা পেশায় রাজমিস্ত্রি।  মা আইসক্রিম বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাতেন।  কখনও কখনও আইসক্রিম নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হত বাড়ির বড় ছেলে রিচার্লিকেও।

‘‘আমার হাতে এত আঙুল ছিল না, যে গুনব কত ক্লাব আমাকে

ফিরিয়ে দিচ্ছে! ফুটবল ছেড়েই দেব ভেবেছিলাম।’’

রিচার্লিসনরা পাঁচ ভাই-বোন।  বড় হিসাবে তাঁর উপরে দায়িত্ব বরাবরই ছিল বেশি।  সংসারে নিত্য অভাব, কোনও কোনও দিন আধপেটা খেয়েও শুয়ে পড়েছেন রিচার্লিসন।  চোখে শুধু একটাই স্বপ্ন— ফুটবল।  একটি সাক্ষাৎকারে রিচার্লিসন জানিয়েছিলেন, ৭ বছর বয়সে তাঁর বাবা তাঁকে প্রথম এনে দিয়েছিলেন ফুটবল।  বাবার দেওয়া সেই উপহার পাথেয় করেই বড় হয়েছেন তিনি।  ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতেন চুটিয়ে।  খেলতে খেলতে ভুলে যেতেন যাবতীয় অভাব-অনটনের কথা।

রিচার্লিসনরা ব্রাজিলের যে এলাকায় থাকতেন, সেখানকার পরিবেশ খুব একটা ‘শিশুবান্ধব’ ছিল না।  মাদক পাচার থেকে শুরু করে বেআইনি নানা ব্যবসা চলত দিনভর।  তাঁর বন্ধুরাও বেআইনি মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  যার ফলে বড়সড় বিপদের মুখে পড়েছিলেন ব্রাজিলের এই ফুটবলার।

সাক্ষাৎকারে রিচার্লিসন বলেছেন, ‘‘আমার বন্ধুরা প্রায় সকলেই নিষিদ্ধ মাদক বিক্রি করত।  কারণ, তাতে কম সময়ের মধ্যে অনেক টাকা রোজগার করে ফেলা যায়।  কিন্তু এটা যে ঠিক নয়, সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।  ওরা মাদক বিক্রি করত।  আর আমি বিক্রি করতাম আইসক্রিম, চকোলেট। গাড়িও পরিষ্কার করেছি।  কারণ, আমি সৎপথে রোজগার করে মাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।’’

মাদক পাচারকারী বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে মিশতে কী ভাবে বিপদে পড়েছিলেন রিচার্লিসন, নিজেই তা জানিয়েছেন।  তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, একবার বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় ১৪ বছরের রিচার্লিসনকে ধরে ফেলেছিলেন এক মাদক পাচারকারী।  তাঁর মাদক চুরি হয়ে গিয়েছিল।  ওই পাচারকারী ভেবেছিলেন, চোর রিচার্লিসনই।  কিশোর ফুটবলারের মাথায় পিস্তলও ঠেকানো হয়েছিল সে দিন।

অতীতের সে দিনের কথা স্মরণ করে রিচার্লিসন বলেছেন, ‘‘সেই মুহূর্তে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।  এক বার যদি পিস্তল চালিয়ে দিত, সব শেষ হয়ে যেত।  ও আমাকে বলেছিল, আর যদি আমাকে আর আমার বন্ধুদের রাস্তায় খেলতে দেখে, তা হলে মেরেই ফেলবে!  সেটা বলে অবশ্য ছেড়ে দিয়েছিল।’’

রিচার্লির বাবা তাঁকে ফুটবলার হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।  শত অভাবের মাঝেও ফুটবলকে তিনি তাই হারিয়ে যেতে দেননি।  রাস্তায় খেলতে খেলতে এক সময় রিচার্লির পায়ের জাদু চোখে পড়ে স্থানীয় এক শিল্পপতির।  সেখান থেকেই ইতিহাসের শুরু।

সেই শিল্পপতি কিশোর রিচার্লিকে নতুন এক জোড়া বুট কিনে দিয়েছিলেন।  নিয়ে গিয়েছিলেন ‘আমেরিকা মিনেইরো’ নামের একটি দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাবে।  সেখান থেকেই রিচার্লির উত্থান শুরু।  পরে ডাক পান ইংল্যান্ডের ওয়াটফোর্ড ক্লাবে।  আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

ওয়াটফোর্ড থেকে এভার্টন ক্লাবে যান রিচার্লি।  ২০২২ সালে তাঁকে ৬ কোটি পাউন্ড (ভারতীয় অর্থমূল্যে প্রায় ৫৯২ কোটি টাকা) খরচ করে কিনে নিয়েছে টটেনহ্যাম।  সাফল্য সহজ ছিল না।  এক সময় ইউরোপের একের পর এক ক্লাব তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।  ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন।  রিচার্লির কথায়, ‘‘আমার হাতে এত আঙুল ছিল না, যে গুনব কত ক্লাব আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে!  ফুটবল ছেড়েই দেব ভেবেছিলাম।’’

বর্ণবৈষম্য থেকে শুরু করে পুলিশি জুলুম, অবিচার— মাঠের বাইরে নানা সময়ে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে রিচার্লিসনকে।  ২০২০ সালে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে ব্রাজিলের ২-০ জয়ে একটি গোল করেছিলেন রিচার্লি।  তবে সেই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না।  যা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘‘বিদ্যুৎ না থাকায় আমার গোল তো এখানকার মানুষ দেখতেই পাবেন না!  আশা করি এই সমস্যার সমাধান শীঘ্রই হবে।’’

মাঠে হোক বা মাঠের বাইরে, নানা বিষয়ে বরাবরই ঠোঁটকাটা ব্রাজিলের রিচার্লি।  দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে এখন তিনি বিশ্বকাপের নায়ক।  তাঁর সাইড ভলি নিয়ে চর্চা থামতেই চাইছে না।  ব্রাজিল নিয়ে বিশ্বকাপের প্রত্যাশার পারদ এক রাতেই চড়িয়ে দিয়েছেন রিচার্লিসন।  তাঁকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন আপামর ফুটবলপ্রেমী।

সৌজন্যে: আনন্দবাজার