যে কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের আত্মহত্যার বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হুট করেই তাঁরা জীবনের ইতি টানছেন। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে কোথাও ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, কোথাও জীবন-জীবিকার সংকট, কোথাও মাদকাসক্তি, আবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে একাডেমিক ফলাফল আশানুরূপ না হওয়া, এছাড়াও যোগ্যতা অর্জন করেও যথাযথ কর্মস্থল না পাওয়া ইত্যাদি।

মনোবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, চাওয়ার সঙ্গে না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, রোগ-বালাই, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই অনেক সময়ই মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। সেই চাপ থেকেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আত্মহত্যা থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিভাগে মাসে অন্তত একবার হলেও কাউন্সেলিং করা উচিত। পরিবারকেও নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। পাশাপাশি পরিবার থেকে নৈতিকতা, ধর্মীয় চর্চার প্রসার, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় আড্ডা দিচ্ছে এসব তদারকি করা দরকার বলে জানা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় জানা যায়, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬ বছর পার করলেও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়োগ দেয়নি কোনো চংুপযরধঃৎরংঃ (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ)। এতে মাদকাসক্ত, মানসিক অবসাদ বা হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর এই বৃহৎ বিদ্যাপীঠে যেখানে কয়েকজন মনোবিদ থাকার কথা সেখানে একজনও নেই।

অবশ্য চলতি বছরের ৪ জুন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রীর ডা. দীপু মনির উপস্থিতিতে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড.শিরীন আখতার বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সেন্টারে পুনরায় কাউন্সিলিং সেবা চালু হওয়ার আশ্বাস দেন।

তিনি বলেন, আমি দেখছি আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেকই হতাশায় ভোগে, ট্রমায় চলে যায়। সম্প্রতি আমাদের শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনায় সাইকোলজি বিভাগকে আমাদের মেডিকেল সেন্টারে আগে যে কাউন্সিলিং করা হতো তা পুনরায় চালু করার অনুমতি দিয়েছি। ভবিষ্যতে হল গুলোতে এই সেবা চালু করা হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং সেবা চালু করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রকোপ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় এই সেবা। এর আগে এই সেন্টারে সেবা নেন শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

প্রসঙ্গত, আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২১ সালে সারা দেশে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে আত্মহত্যা করেছে ৭৯ জন। বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, যা ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা শতকার ৬২ জন। ২০২২ সালে এবং তার পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানা যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও তার ব্যতিক্রম নয় ক্রমেই বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা। চবিতে গত এক যুগে ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে আত্মহত্যা করেছেন উনিশ জন।

চলতি বছরের ১৯ জুন রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সামি চৌধুরী আত্মহত্যা করেছে। চট্টগ্রাম শহরের একে খান এলাকায় একটি বাসায় তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

২৫ মে তেলাপোকা মারার ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে চবির ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশ্যে না আসলেও তার বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলায় বলে তথ্য পাওয়া যায়।

৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ২১০ নং কক্ষে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী রোকেয়া খাতুন (রুকু)। আত্মহত্যার মূল কারণ অস্পষ্ট থাকলেও স্বামী কর্তৃক মানসিক নির্যাতন, গর্ভপাত এবং পরীক্ষা দিতে না পারার অভিযোগ সামনে আসে। দুই মাসের ব্যবধানে আত্মহত্যা করে তিন জন শিক্ষার্থী।

২০০৮ সালে চবি লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সাইফুল ইসলামের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছর আত্মহত্যা করেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অ্যান্ড্রু অলক দেওয়ারি। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আত্মহত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর দিদারুল আলম চৌধুরীসহ আটজন। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোনো ছাত্র-শিক্ষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৭ সাল থেকে আবার বাড়তে শুরু করে আত্মহত্যার প্রবণতা। ওই বছরের ৭ মার্চ ফ্যানে ঝুলন্ত বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০২২ সালে শাহজালাল হলের বিপরীতে কটেজে শিক্ষার্থী অনিকের ৬ পৃষ্ঠা চিরকুট লিখে রহস্য জনক ভাবে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।

উল্লেখযোগ্য এই ঘটনাগুলো ছাড়াও আরো অনেকে আত্মহত্যা করেছে কিংবা বিভিন্ন সময়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে।

এআই