রোববার (১২ নভেম্বর) সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারে প্রকাশিত ভারতীয় সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দিল্লি যেভাবে ঢাকার পাশে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাতে খুশি। দলটির এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, ‘আমেরিকাকে যেভাবে জবাব দিয়েছে ভারত, তার একটা প্রভাব এবার ওয়াশিংটনের আচরণে পড়বে বলে আমরা মনে করি।’
আবার ভারতের এই অনড় অবস্থানে হতাশ বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অন্য দলগুলো। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বৈঠকের আগে ভারতীয় কূটনীতিকদের কাছে নিজেদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা দিল্লি সফর করেছিলেন। কিন্তু তাতে যে কাজ হয়নি, ভারতের স্পষ্ট বার্তাই তার প্রমাণ। এতে আরও বলা হয়, গ্রেফতার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা বিএনপির এক নেতা টেলিফোনে বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে এই আচরণ কাম্য ছিল না। অবৈধ সরকারের পাশে দাঁড়ানোয় তারা বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাবেন। যদিও বক্তব্য দেয়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতার নাম প্রকাশ করা হয়নি আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘অতিসক্রিয়তা’ দেখাচ্ছে, নির্বাচনকে জড়িয়ে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে; এ সবই সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থি। এমন পরিস্থিতিতে ফের মৌলবাদী শক্তি বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। এদিকে ভারতের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তাতে যেসব আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথা হয়েছে, তার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সেখানে আর কোনো কথা বলা হয়নি। আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের কথায়, আমাদের আশা, বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশ ভারতের এই মনোভাবকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বাংলাদেশে আমেরিকার নাক গলানো বন্ধ না হলেও, কমবে। প্রকৃত বন্ধুর মতো আবার পাশে দাঁড়াল দিল্লি। সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে নাক গলিয়ে চলছিল, তার জবাব দেয়া দরকার ছিল। দিল্লি ঢাকার পাশে দাঁড়িয়ে সেই কাজটাই করেছে।
কী বলেছে ভারত
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত কয়েকমাস ধরে অতি আগ্রহ দেখাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বছর প্রায় ১৫ বার মার্কিন প্রতিনিধিরা সফর করেছেন বাংলাদেশে। নির্বাচনের আগে পুরানো ভিসানীতি নতুন করে ঘোষণা করেছে দেশটি। আর ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বরাবরই বক্তব্য দিয়ে আসছেন নির্বাচন নিয়ে। এর মধ্যেই শুক্রবার ভারত সফর করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। এর আগেই দিল্লিতে উড়াল দেন পিটার হাস। প্রত্যাশিত ছিল মার্কিন মন্ত্রীদের সঙ্গে ভারতের মন্ত্রীদের বৈঠকে উঠে আসবে এদেশের নির্বাচন ইস্যু। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন মন্ত্রীদের বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কাত্রা। তিনি জানান, ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের নেতারা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিনয় কাত্রা বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কেমন হবে, নির্বাচন কেমন হবে, তা সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তা ঠিক করবেন। বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল করে তুলতে সে দেশের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারত বরাবর সমর্থন করে আসছে। সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আরও বলেন, বৈঠকের বর্ধিত আলোচনায় আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি। তৃতীয় কোনো দেশের বিষয়ে ভারত কখনোই মাথা ঘামায় না।
বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, তা সে দেশের জনগণই ঠিক করবে উল্লেখ করে বিনয় কাত্রা বলেছেন, ‘তারাই (জনগণ) তাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারত। সেদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত শ্রদ্ধাশীল।’
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া ভারতের বক্তব্য কূটনীতির কড়া বার্তা বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ভারতের এ বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে মার্কিনিদের নাক না গলানোর বার্তা স্পষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ড. ওয়ালিউর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, ভারতের ব্ক্তব্য কূটনৈতিক ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া বার্তা। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের প্রগতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখতে মার্কিনিদের নির্বাচনে মাথা না ঘামানোর বার্তা স্পষ্ট হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারত বলেছে যে, বাংলাদেশে যে নির্বাচন হবে সেখানে কেউ কথা বলুক আমরা তা চাই না। এই বার্তাটাই তারা দিয়েছে। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে এই কথাটাই ভারত বোঝাতে চেয়েছে যে, আপনারাও (যুক্তরাষ্ট্র) নাক গলাতে আসবেন না। গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন হোক, নির্বাচনের পরে যদি আপনাদের কিছু বলার থাকে; তখন বলতে পারেন। উপমহাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন বার্তায় নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের তোড়জোড় কিছুটা কমবে বলেও মনে করেন ড. ওয়ালিউর রহমান। উল্লেখ্য, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনায় প্রত্যাশিতভাবে উঠে এসেছে নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। বৈঠকে ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের চিন্তাভাবনার কথা আরেকবার যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেয়া হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে ওই বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
জল্পনার অবসান
গেল সেপ্টেম্বরে জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ ভারতের বিশেষ আমন্ত্রণে দিল্লি সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জোট নেতাদের মধ্যে মূল আলোচনাতেও অংশ নেন তিনি। এছাড়া দিল্লিতে পৌঁছেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন শেখ হাসিনা। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির বাসভবনেও একান্ত আলোচনায় বসেন দুই নেতা। ওই বৈঠকে অত্যন্ত ‘ফলপ্রসূ আলোচনা’ হয়েছে বলে নিজেই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে জানান নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি, বাংলাদেশকে বহু বছর ধরে ভারত যে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে, তা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। গত তিন মেয়াদে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছে ভারত– ফলে এবারের নির্বাচনের আগে ভারত ঠিক কী ধরনের অবস্থান নেয়, সেদিকে সতর্ক নজর সবার। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘ভিসানীতি’ ঘোষণা করার পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার নামে ওয়াশিংটন অতিসক্রিয়তা দেখাচ্ছে কি না। সার্বিক বিষয়ে ভারতের অবস্থান কী, তা নিয়েও নানা ধরনের জল্পনার সৃষ্টি হয়। এছাড়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একই মত পোষণ করে- এমন ইঙ্গিত দিয়ে বিভিন্ন সময় ভারতের অনেক সংবাদমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিতর্কও কম হয়নি। তবে গত সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার বৈঠক এবং সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া ভারতের বার্তা থেকে সব জল্পনার অবসান হয়েছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।