মে দিবস: মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য সংগ্রাম

“যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে

জীবনে মরণে।

ওরা চিরকাল

টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,

বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে,

ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে ।

………………………

ওরা কাজ করে দেশ দেশান্তরে”।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লেখক সুভাষ দে

মহান মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের উৎসব, সংহতি চেতনার দিন। অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এই দিনটির অর্জনে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে দেশে দেশে সংগ্রাম-আন্দোলন করতে হয়েছে দশকের পর দশক ধরে, এমন কি শতাব্দীর পর শতাব্দী চলেছে এর নিরন্তর সংগ্রাম। এক সময় দাস শ্রমিক প্রথা ছিলো বিশ্বজুড়ে। তাদের ইচ্ছা- অনিচ্ছা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন দাস মালিকদের কাছে বাঁধা ছিল। এরপর সামন্ত যুগে এসে উৎপাদনের ধরন ও পদ্ধতি বদলে যায়। শুরু হয় কৃষি সভ্যতা, কৃষিজীবী, কৃষক, দিনমজুর এদের হাতেই উৎপাদন, মানুষের ভোগের সামগ্রী তৈরি হতে শুরু করে। এই সময় মানুষ একসাথে বাস করতে শুরু করলে গ্রামীণ লোকসমাজ গড়ে ওঠে। লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, এককথায় সমাজের কৃষ্টি ও উন্নত জীবন লাভের আকাক্সক্ষা তখন থেকে শুরু হয়। আমাদের এই উপ-মহাদেশের এই সমাজ এখনো প্রতিষ্ঠিত। যদিও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উৎপাদনের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে তবু বিপুল বিস্তৃত গ্রাম-সমাজ জীবনে সামন্তবাদী সমাজের ধ্যান ধারণা, প্রবলভাবে মানুষের মর্মে গেঁথে আছে।

এরপর এলো শিল্প বিপ্লবের যুগ। ইউরোপ-আমেরিকা এর পথপ্রদর্শক। ষোড়শ শতাব্দী থেকে এর উন্মেষকাল, এখন বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও মানুষের উদ্ভাবনতার ফলে বিশ্ব সভ্যতা, বিশ্বলোকসমাজ চূড়ান্ত বিকাশের স্তরে পৌঁছেছে। সভ্যতা নবস্তরে উন্নীত হলো শ্রমজীবী মানুষের হাতে। মানুষের সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ, ভোগের সামগ্রী বিপুল নির্মাণযজ্ঞ তাদের শ্রম থেকে উৎসারিত, বলা যেতে পারে সভ্যতার সচল রথের সারথি তারা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কতগুলি যুগান্তকারী আবিষ্কার যেমন বাষ্পীয় ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ, উইভিং মেশিন, পরে রেল ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর যোগাযোগ ও শিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। ইউরোপের নানা দেশ, আমেরিকা কানাডায় প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ায় শিল্পযুগের এক অভাবনীয় বিস্তার ঘটে। আমাদের এই উপমহাদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব পড়তে শুরু করে।

শিল্প বিপ্লবের যুগের প্রথমদিকে শ্রমিকদের অবস্থা ছিলো দুর্বিষহ। তাদের অমানুষিক শ্রমে খাটাতো পুঁজির মালিক, শিল্পের মালিক, দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা খাটুনি খাটতে হতো, নারী ও শিশু শ্রমিকদের অবস্থা ছিলো ভয়াবহ । ১৮৩০ সালে প্রথম সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় ইংল্যান্ডে। ১৮৩৬ সালে শ্রমিকরা তৈরি করে চার্টার অব ডিমান্ড, এটি চারটিস্ট মুভমেন্ট নামে পরিচিত। মূল দাবি ছিল কর্মঘণ্টা কমানো। ক্রমে ইউরোপ-আমেরিকার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিক আন্দোলন। নারী শ্রমিকরাও শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন।

আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায় ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে কয়েক লক্ষ শ্রমিকদের প্রতিবাদ সমাবেশে। প্রধান দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি। সেই সাথে ন্যায্য মজুরি ও শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। তিন লক্ষাধিক শ্রমিকের ঐ সমাবেশে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হয় ১০ জন শ্রমিক। আহত হয় শত শত। প্রহসনমূলক বিচারে কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হলে জনতা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের যে গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন তার মহিমা আজো অম্লান। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ এই দিনটির মর্মবাণী থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে অধিকার চেতনা শানিত করে। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর ‘মে দিবস রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় ।

বিশেষ করে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমিকদের অধিকার-মর্যাদা, তাদের জীবনমানের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, আত্মদানের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের শ্রমজীবী, দিনমজুর ও কৃষক সমাজ গৌরবময় ভূমিকা পালন করে । আমাদের শাসক শ্রেণি, প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ, বৃহত্তর জনসমাজ ও রাজনীতিবিদদের শ্রমজীবী মানুষের এই ভূমিকা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় ।

উন্নত দেশে শ্রমজীবী মানুষ ব্যাপক অধিকার, সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও আমাদের দেশে শ্রমজীবী, কৃষিজীবী ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপনের পাঁচালী খুবই করুণ। কবি সুকান্তের ভাষায়- তারা যেন সেই বাতিওয়ালা, সভ্যতার আলো জ্বালায় সবখানে অথচ নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার ।

যে বিপুল কর্মজীবী, শ্রমজীবী, কৃষিশ্রমিক গ্রামে ও শহরে উৎপাদন, অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের চাকা সচল রাখছে তাদের অধিকার, মর্যাদা ও জীবনমানের উন্নতির প্রশ্নে এখনো অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আমাদের দেশে এখন শিল্প ও অর্থনীতির নানা খাত বিকাশমান। গার্মেন্টস, স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল- বেকারি, চা, বস্ত্র এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মজুরি এতই কম যে তাতে জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে। জাহাজভাঙা শিল্প, রি-রোলিং, অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবহন খাতে শ্রমিকদের অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয় । শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমিক ছাঁটাই ব্যাপক।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দিকটিতে এখন কিছুটা মনোযোগ এসেছে। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, নিয়োগ কর্তৃপক্ষ, আইএলও এবং সরকারের প্রচেষ্টায় গার্মেন্টস শিল্পে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এ প্রচেষ্টা অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র গার্মেন্টসে শ্রমজীবী মানুষের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সংকুচিত, শ্রমিকদের বেতন – মজুরি বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। নারী ও পুরুষের মজুরির ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যও আছে, পারিবারিক ও কৃষিকাজে নারীশ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন নেই । আমাদের দেশে অনেক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। মধ্যবিত্ত, কৃষিজীবী ও শ্রমজীবীদের চড়ামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মতো সেবা কিনতে হয়। প্রবাসী শ্রমিকদের অবস্থা খুবই করুণ। তাদের বেতন ভাতা, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে নিয়মের বালাই নেই। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যাতে বিধিবিধান মেনে চলে সেজন্য আইএলও এর চাপ প্রয়োগ প্রয়োজন ।

শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ যেমন শ্রমনীতি, গার্মেন্টস ক্ষেত্রে শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড, মজুরি নির্দিষ্টকরণ, অপ্রতিষ্ঠানিক অনেক পেশায় প্রভিডেন্ট ফান্ডের নীতিমালা, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা উল্লেখযোগ্য। তবে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, শ্রমিকদের কাজের স্থায়িত্ব, বাজারমূল্যের সাথে সংগতি রেখে মজুরি নির্ধারণ, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, সুলভে সেবা পাওয়া এসবে রাষ্ট্র ও উদ্যোক্তাদের মনোযোগ দিতে হবে ।

দেশের বড় বড় শিল্প সেক্টরগুলিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেনি। এর ফলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রকৃত মজুরি নির্ধারণ, কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা, স্বীকৃত মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার দাবি জানালে তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে নানা অজুহাতে, নানা কায়দায় কর্মস্থল থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

আমাদের দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও নানা বিভক্তি, মালিকরা শ্রমিক নেতাদের নানা কায়দায় ম্যানেজ করে ফেলেন, ফলে শ্রমিক স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। অনেকে ক্ষোভ বঞ্চনা থেকে নৈরাজ্যের আশ্রয় নেন। অতীতে আমরা এই নজির দেখেছি। বর্তমানে এ ধরনের পরিস্থিতি অনেক কমে এসেছে। শ্রম ব্যবস্থাপনা আধুনিক, প্রগতিশীল করতে হলে উদ্যোক্তা-শ্রমিক সম্পার্কের উন্নয়ন প্রয়োজনে এখন প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ, প্রশিক্ষিত শ্রমিক। এটি করা গেলে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা এবং শ্রম ব্যবস্থাপনায় বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হতো। উদ্যোক্তা শ্রেণি এবং সরকারকে প্রশিক্ষণ, বৃত্তিমূলক, কর্মমুখি শিক্ষায় ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে উপজেলা ভিত্তিক ।

বিদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ প্রশিক্ষিত লোক তৈরি করতেও এর প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের শ্রমশক্তির এক বড় অংশ নারী। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে নারীরা কাজ করছেন; গার্মেন্টস শিল্পে ৯০ ভাগ নারী, তাছাড়া কৃষি উৎপাদন, কৃষিসহায়ক শিল্পে নারীরা এখন কর্মমুখর সময় পার করছেন । গ্রামীণ অর্থনীতিতে আমাদের দেশের নারীরা বড় অবদান রাখছেন কিন্তু তাদের সামগ্রিক কাজের মূল্যায়নে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র কুণ্ঠিত। তারা মজুরি-বৈষম্যের শিকার, তাছাড়া কর্ম পরিবেশও তাদের জন্য সর্বাংশে অনুকূল নয় । মজুরি-বৈষম্যের অবসান না ঘটলে উৎপাদনেও ঘাটতি থাকবে। শ্রমের গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের মতো দেশের সামাজিক কাঠামোতে নারী শ্রমজীবীরা যেভাবে বাধা, প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে আসছেন তা দক্ষিণ এশিয়ায় দৃষ্টান্তস্বরূপ।

একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত জনগণের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব অধিকার পূর্ণ করার সুযোগ সৃষ্টি করা। বৈষয়িক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির যোগান দেবে রাষ্ট্র, তার নানা সংগঠন ও সংস্থা। এসব নাগরিককে সম্পূর্ণ ‘মানব’ হয়ে ওঠার আয়োজনে শামিল করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর ফলে তার সামাজিক- সাংস্কৃতিক চাহিদা থাকে অপূর্ণ, তার স্বজন ও সন্তান সন্ততিরাও অপ্রাপ্তির একই চক্রে আটকে থাকে।

একজন শ্রমজীবী কিংবা কৃষিজীবী কেবল শ্রমদাস নয়, তার হাত দিয়েই ভোগের উপকরণ সৃষ্টি হয়। আজকের বিশ্বসভ্যতার যে এগিয়ে চলা তার ভিতটিও নির্মাণ করেছেন শ্রমজীবী মানুষ । কাজের নির্দিষ্ট সময় ও ন্যায্য মজুরি এজন্যই প্রয়োজন যাতে কর্মজীবী মানুষ পরিপূর্ণ বিশ্রাম, বিনোদনের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে, এটি কেবল তার কর্মক্ষমতাই বাড়ায় না বরং তাকে মানসিকভাবে তৃপ্তিও দেয়, সে মনে করে তার ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক