চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী বাজার ‘মিঠাছড়া বাজার’। যা উপজেলার সদর ৯ নম্বর ইউনিয়নের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন এলাকায় কয়েকশ বছর আগে গড়ে উঠেছিল।
বাজারটি একসময় হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য, মাছ-তরিতরকারী ও সাপ্তাহিক পশু-পাখির হাটবাজরের জন্য প্রষিদ্ধ ছিল। উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় এই বাজারে। তবে সময়ের ব্যাবধানে, রাজনৈতিক কালো থাবায়, বাজার পরিচালনা কমিটি ও ইজারদরদের অনিয়মে সব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। এক সময়ের ঐতিহ্য হারিয়ে এখন বাজারটি মাদকের রাজধানীতে পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাজারটিতে এখন হাত বাড়ালেই মেলে গাজা, হেরোইন, ফেনসিডিল ও ইয়াবাসহ ভয়ঙ্কর সব মাদক দ্রব্য। এখানে দিনদুপুরে মাদক দ্রব্য বেচাকেনা হয় পাইকার ও খুচরায়। বাজারের আশপাশে কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে মাদক কারবারিরা। প্রশাসনিক নিরাবতা ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে নির্বিগ্নে মাদক ব্যবসা করে অতি অল্প সময়ে মাদক কারবারিরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। অল্প সময়ে দ্রুত বড়লোক হওয়ার এই লোভ প্রভাব ফেলছে সাধারণ সমাজেও। ফলে অনেক নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ দ্রুত বড়লোক হতে ঝুঁকছে মাদক ব্যবসায়।
আরও জানা গেছে, এসব মাদক কারবারিদের বড় অংকের অর্থের যোগান ও আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। বিনিময়ে মাদক ব্যবসার মোটা অংকের মাসোহারা চলে যায় তাদের পকেটে। তাই এখানে মাদকের স্বর্গরাজ্য গড়ে উঠেছে দিবালোকে।
একসময় উপজেলার জোরারগঞ্জ, মিঠাছড়া, মিরসরাই, নিজামপুর, কমলদহ ও বড়দারগারহাটসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজার কেন্দ্রিক মাদকসেবিরা বারৈয়ারহাট কিংবা করেরহাট বাজারে গিয়ে মাদক ক্রয় করতো ও সেবন করতো। কিন্ত বর্তমানে মিঠাছড়া বাজারের মাদক ব্যবসায়ীরাই পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মাদক ব্যবসায়ীরা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত। প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় সময় এদের মধ্যে মারামারি ও হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার ঘটনায় একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করে থানায়। থানায় মামলা করে ও রাজনৈতিক তদবির করে এক পক্ষ অপর পক্ষকে গায়েল করতে থানা পুলিশকে ব্যবহারের উদাহরণও রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ইউপি সদস্য দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, মিঠাছড়া বাজারের পূর্বপাশের শ্রীপুর ও আবুনগর এলাকা। এখান থেকেই মূলত মাদক ছড়ায় মিরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাংলা মদ থেকে শুরু করে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাজাসহ সব কিছুই খুচরা ও পাইকারে বেচাকেনা চলে সকাল-সন্ধ্যা। অনেক বড় কারবারিও রয়েছে এখানে। প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার পাইকারে মাদক বেচাকেনা চলে।
তিনি আরও জানান, এসব মাদক কারবারিরা এলাকায় চিহ্নিত এবং মামলার আসামি। পুলিশ তাদেরকে একাদিকবার গ্রেফতার করেছে।
জানা গেছে, জসিম ও তার ভাই ফুলসাব বাংলা মদের ব্যবসার গ্যাং চালায়। বাহার তার ভাই খোকন এবং বোন কোহিনুর ইয়াবা ব্যবসার গ্যাং পরিচালনা করে। অন্যদিকে মেজবাউল আলম, শানা, বোতল রাসেল, সেক্রেটারি রাসেল, আরিফ ও ইকবাল মূলত ফেনসিডিল বেচাকেনায় জড়িত।
আরও জানা গেছে, এসব মাদক কারবারিদের মধ্যে কেউ ডাকাতি মামলা, কেউ মাদক মামলায় একাদিকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছে। তারা জামিনে এসে আবারও মাদক ব্যবসা শুরু করে।
স্থানীয়রা জানান, গাজা যদিও গরীবের সন্তানরা খায়, ইয়াবা ও ফেনসিডিল সেবন করে মূলত অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সন্তান, মাঝারি পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিরা। এসব জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা নিজেদের মাদক সেবনের নিরাপত্তার সার্থে মাদক কারবারিদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় ও পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে সহায়তা করে।
মিরসরাই ৯ নং সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম জানান, ইকবাল, বাহার, রাসেল, আরিফসহ অনেকেই ইলেকশনের সময় নৌকার পক্ষে আমার জন্য কাজ করেছে। তবে ইলেকশন শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সবাইকে ডেকে মাদক ব্যবসাসহ সকল খারাপ কাজ ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার এন্ট্রিগ্রুপের সাথে জোট করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে।
তিনি আরও জানান, উপজেলা সমন্বয় সভায় চিহ্নিত মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বহুবার আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রাজনৈতিক তদবিরের তোকমা দিয়ে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে।
মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবির হোসেন দেশ বর্তমানকে বলেন, মিঠাছড়া এলাকার মাদক সম্রাট ইকবালসহ অনেককেই একাধিকবার আমরা গ্রেফতার করেছি। তারা জামিনে এসে ফের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমি সেই সব প্রভাবশালীদের নাম বলব না। আপনি স্থানীয়দের মতামত নিয়ে তাদের (মাদক কারবারি ও প্রভাবশালী) নাম লিখুন। আমরা পুলিশ প্রশাসন ওই এলাকায় মাদক বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করবো।
দেশ বর্তমান/এআই