মাদক সম্রাট শুক্কুরের যুবলীগ নেতা হওয়ার শখ!

নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে, পুলিশকে জিম্মি করে পার পেয়ে যায় বারবার

বাবা বিএনপির ক্যাডার। নামটা শামসুল ইসলাম হলেও লোকমুখে তিনি মাচ্ছো শামসু হিসেবেই ছিলেন বেশ পরিচিত। তবে তার ছেলে মো. শুক্কুর নিজেকে পরিচয় দেন যুবলীগ নেতা হিসেবে। রেলওয়ের জায়গা দখল করে অবৈধভাবে ঘর তুলে দীর্ঘ এক যুগেরো বেশি সময় ধরে আধিপত্যের সাথে সিআরবির তুলাতলী বস্তিতে বসবাস করছে শুক্কুর। আর বস্তি ঘিরে চলছে গাঁজা, বাংলা মদ, ইয়াবা সহ বিভিন্ন প্রকার মাদকের রমরমা বানিজ্য। বস্তি থেকে নিয়ন্ত্রন করেন পুরো সিআরবি এলাকার বিভিন্ন অপকর্মের সিন্ডিকেট। সিআরবি পুলিশ ফাঁড়ি বিভিন্ন মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করলেও কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের যোগসাজসে পার পেয়ে যায় বারবার।

বস্তির মাদক সম্রাট শুক্কুর ও তার তিন ভাই, ভাবি-বোন মিলে চালায় পারিবারিক মাদকের রমরমা ব্যবসা। তার হাতেই যেন বন্ধি তুলাতলী বস্তির প্রায় সাড়ে তিন’শ পরিবার। এলাকার প্রতিটা মাদক স্পট থেকে তোলেন দৈনিক দুই হাজার টাকা করে চাঁদা। এছাড়াও প্রতি কেজি গাঁজায় নেন হাজার থেকে পনের’শ টাকা।

পুলিশের সাড়াশি অভিযানে চুনোপুটিরা আটক হলেও ধরাছোয়ার বাইরেই থেকে যায় শুক্কুর ও তার পরিবার। তারা যেন প্রশাসনের কাউকে তোয়াক্কাই করে না। একাধিক মামলা কাঁধে নিয়ে সগৌরবে নিয়ন্ত্রন করেন পুরো মাদক সিন্ডিকেট। শুক্কুর ও তার পরিবারের বদৌলতে সিআরবির আনাচে কানাচে বসে মাদকের আসর, লাগে মাদক বিকিকিনির হিড়িক। এই সকল মাদকের মধ্যে রয়েছে বাংলা মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ নানা ধরনের নেশা দ্রব্য।

এরমধ্যে আলম (৫২) ও মানিক (৪০) দীর্ঘদিন যাবত ওই এলাকায় মাদক ব্যবসায় জড়িত। তারা দুজনেই শুক্কুরের আপন বড় ভাই। জনসম্মুখে বিক্রি করেন মাদক। শুধু ভাইয়েরা নন সাথে আছে তাদের বোন শাহীনা, মানিকের বউ মনি বেগম (৩৬) ও আলমের বউ হীরা আক্তার।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, আলম, মানিক মানিকের বউ মনি বেগম ও মাদক সম্রাট শুক্কুরের নামে রয়েছে একাদিক মাদক, প্রতারণা ও চুরির মামলা। যার সংখ্যা প্রায় ৩০-৩৫ টি। এছাড়াও সর্বশেষ গত ০৭ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর স্টেশন রোডের পাখি গলিতে আরেক মাদক ব্যবসায়ী মনা ছুরিকাঘাতে ও পায়ের রগ কেটে হত্যার ঘটনায় অন্যতম আসামি এই শুক্কুর। খুনের আগের রাতে শুক্কুর ও তার কিশেরি গ্যাং সদস্যরা মনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সিআরবির মালি পাড়া এলাকায় সশস্ত্র মহড়া চালায়। খুনে জড়িত দুই যুবক ধরা পড়লেও শুক্কুরসহ খুনের মূল হোতাদের এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। ২০২২ সালের ০৭ মার্চ শুক্কুরের সাম্রাজ্জের অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে শুক্কুর ও তার বাহিনীর হাতে মারাত্মক হামলার শিকার হন রেলের ৯ কর্মী। উক্ত ঘটনায় সরকারী কর্মচারীদের মারধর মামলারও প্রধান আসামী শুক্কুর।

সিআরবি পুলিশ ফাঁড়ির তথ্যমতে, গত ১০ মাসে (এপ্রিল-২০২৩ থেকে জানুয়ারি-২০২৪) সিআরবি ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে মোট ৯৫ কেজি গাঁজা উদ্ধার করেছে পুলিশ। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও ৩ হাজার ১শ ৭০ পিস ইয়াবা ও ১হাজার ৫শ ১০ লিটার চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়।

গেল ১০ মাসে মাদক ক্রয় ও বিক্রয়ের অপরাধে মোট ৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েন। তবে প্রতিবারই পার পেয়ে যায় সিআরবির মাদক সম্রাট মো. শুক্কুর।

প্রশাসন সহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের বারংবার অভিযানের পরেও কিভাবে এখানে অবৈধ দখলদার ও জমজমাট মাদক ব্যাবসা চলে তা খতিয়ে দেখার দাবী জানিয়েছেন বিভিন্ন মহল।

তুলাতলী বস্তি এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দারা জানান, কিছু অসাধু পুলিশের আদরেই চলছে শুক্কুরের মাদক ব্যবসা। যার জন্য ‘সিকিউরিটি মানি’ হিসেবে কোতোয়ালী থানার টহল পুলিশের গাড়ি দিনে দুইবারে নিয়ে যান চব্বিশ’শ টাকা। এছাড়াও সিআরবি পুলিশ ফাঁড়িতে যায় মাসিক হারে মাসোয়ারা। এর বাইরে ফাঁড়ির দুইজন সহকারী উপ-পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গির আলম এবং মো. সাদেক হোসাইন আলাদা ভাবে পান সম্মানী। পাশাপাশি গুঞ্জন রয়েছে সহকারী উপ-পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গির আলমের সাথে শুক্কুরের রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

ঘটনার সত্যতা জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় শুক্কুরের সাথে। শুরুতেই তিনি দেশ বর্তমান প্রতিবেদককে বলেন, আমি হেলাল আকবর বাবর ভাইয়ের সৈনিক। এরপর তিনি আভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি মাদক বিরোধী আন্দোলন করি। আমার কারণে এলাকায় অনেকেই মাদক বিক্রি করতে পারে না। তাই তারা আমার নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

তিনি দেশ বর্তমান প্রতিবেদককে আরও বলেন, আমি যুবলীগের ফরম নিয়েছি। এই ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হলে আমি দলীয় পদ পাবো না।

তবে সরেজমিনে সিআরবির তুলাতলী বস্তি এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এলাকার লোকজনের দাবি এইসব কিছুর মাস্টারমাইন্ড শুক্কুর নিজেই।

মাসিক মাসোয়ারা এবং ব্যক্তিগত চাঁদার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় সিআরবি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক রনি তালুকদারের কাছে। তিনি দেশ বর্তমান প্রতিবেদককে বলেন, মাত্র দু-মাস হলো আমি ফাঁড়ির দায়িত্ব পেয়েছি। আগে কারা কি নিতো তা আমি জানি না এবং ব্যক্তিগতভাবে শুক্কুরকে চিনিও না। তবে তার অপকর্মের কথা শুনেছি। উপযুক্ত প্রমাণ পেলে অবশ্যই আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিব।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম ওবায়দুল হক দেশ বর্তমানকে বলেন, আমরা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছি। শুধু সিআরবি নয় কোতোয়ালীর প্রতিটা আনাচে কানাচে থাকবে মাদক মুক্ত। এই ব্যাপারে আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না।

এছাড়াও তিনি বলেন, শুক্কুরের বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক মামলা রয়েছে। তকে গ্রেপ্তারে কোতোয়ালী থানা পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছে।