যখন রোগী এবং মৃত্যু বেড়ে যায়, তখনই তাড়াহুড়ো করে মশা মারতে নামে সিটি করপোরেশন। ঢাকায় মশা মারার কিছুটা তোড়জোড় দেখা গেলেও ঢাকার বাইরের চিত্র খতবই নাজতক। তবে লোকদেখানো তোড়জোড়ের সঙ্গে, মশার বংশবৃদ্ধির জন্য জনগতের ওপর দোষ চাপানোর মহড়াও শুরু করেন মশক নিধনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
প্রায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য রক্ত চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেখছি। কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর জানাচ্ছেন। সকলের প্রার্থনায় থাকতে চেয়ে লিখছেন হাসপাতালের শয্যা থেকে। কেউ আবার জ্বর নিয়ে বাসায় শুয়ে-বসে কাতরাচ্ছেন। হাপাতালগুলোতে ছোটাছুটি চলছে। কেউ রোগী ভর্তি করাতে ছুটছেন, কেউ ছুটছেন রোগী সামলাতে। হাসপাতালে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা।
গত দুই যুগ ধরেই ডেঙ্গু আমাদের সঙ্গে একরকম গাঁটছড়া বেঁধে আছে। প্রতিবছরই আমাদের ডেঙ্গু মোকাবেলা করতে হয়। মাঝখানে ২০২০ সালে করোনা এসে ডেঙ্গুর ভয়াবহতাকে হালকা করে দিলেও ডেঙ্গু আমাদের ছাড়েনি। মনে হয়েছে করোনার থাবা মোকাবেলা করা মানুষের কাছে ডেঙ্গু খতবই ঠতনকো। কিন্তু সত্যটা হলো করোনায় মানুষ ভয় পেয়েছিল বেশি। প্রথমদিকে আমাদের প্রস্তুতিহীনতা কোভিড-১৯-কে জটিলতর করে তুলেছিল।
কোভিড-১৯ যে ধাক্কা দিয়ে গেছে, তাতে হয়তো দুই সিটি করপোরেশনের কাছেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কম গুরুত্ব্ পেয়েছে। নজরদারি এবং মোকাবেলার প্রস্তুতি, সবই কম রয়েছে। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশে নেই। হয়তো এই কারতেই দুই মেয়রের একজন বিদেশে। ব্যক্তিগত কারতে তারা দেশের বাইরে আছেন বলে শুনেছি। যদি জনগতকেই দায়িত্ব নিয়ে এগুলো মোকাবেলা করতে হয়, তাহলে তাদের কেন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারাই দায়িত্বে আছেন কেন? কীভাবে তারা সরকার প্রধানের কাছ থেকে ছুটি পেলেন? দেশের জনগণের এমন ঘোর বিপদের দিনে কী, যাদের কাঁধে বিপদ মোকাবেলার দায়িত্ব, তারা অবকাশ যাপনের সুযোগ পেতে পারেন? বিষয়গুলো যে এই প্রথম ঘটছে, তা নয়। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কেন বার বার বিপদের দিনে তারা বাইরে থাকেন? কারত সম্ভবত ভোটের তোয়াক্কা করেন না তারা।
এত বছর ধরে ডেঙ্গু মোকাবেলার অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, সাধারণত অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন গতমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে একদিনে বাংলাদেশে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও গত সাড়ে ছয় মাসে মারা গেছেন ১৪৬ জন। কেবল জুলাইয়ের ২১ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ১২০ জনের।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে এর আগে বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এবং এবার সকল রেকর্ড ইতোমধ্যেই ছাড়িয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলায় এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ২৮১ জন মানুষ মারা যায় ২০২২ সালে। গত বছর সারাদেশে ৬২ হাজার ৩৮২ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সামনে রয়েছে ভয়াল অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস।
এমনকী গত বছরের সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি তাহলে কী চিত্র দেখবো? গতমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, এই বছর জুলাই শেষ না হতেই আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সবমিলিয়ে এ বছর ২২ জতলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৬৮৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি হন ১৮ হাজার ৮৮৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ১১ হাজার ৮০০ জন। এই সংখ্যা একেবারেই হাসপাতাল থেকে নেয়া। তবে এই সংখ্যা যে আরও বেশি তা দ্ব্যর্থহীনভাবেই ধারতা করা যায়। কারত অনেক ডেঙ্গু রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হননি।
প্রতি বছরই ডেঙ্গু মোকাবেলায় সরকারের একটি বাজেট থাকে। গতমাধ্যম সূত্র জানা যায় যে, ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১০২ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। তার একটি বড় কাজ হলো ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ বিভিন্ন কর্মস‚চি নেয়া। দুই সিটি করপোরেশন সেটির কতটকু নিয়েছে, তা না জানলেও তার কোনো প্রভাব ডেঙ্গু বিস্তার রোধে যে পড়েনি, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি এ সময়েও।
ডেঙ্গুর অবস্থা যে ঢাকাতেই শোচনীয় তা নয়, দেশের ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সমান তালে বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর বারান্দাতেও কুলোচ্ছে না ডেঙ্গু রোগী। বাংলাদেশে যেখান প্রতি তিনজন রোগীর জন্য মাত্র একটি সিট, সেখানে এখন একটি সিটের বিপরীতে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাত রয়েছে সাত থেকে আট জন রোগী।
আমাদের ডেঙ্গু মোকাবেলার ধরন দেখে কেউই বিশ্বাস করবে না যে আমরা গত দুই যতগ ধরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাত কতটা নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তা বুঝতে পারি যখন করোনা কিংবা ডেঙ্গুর মত পরিস্থিতি আমাদের সামনে পড়ে।
কেন এই পরিস্থিতিগুলো আমাদের সামনে বার বার আসে? কারত আমরা মানতষের দতর্ভোগকে আমলে নিই না। মানতষের স্বাস্থ্য সতরক্ষার অধিকারকে গুরুত্ব দেই না। যাদের এগুলো দেখভাল করার কথা তারা সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। যখন পরিস্থিতি খারাপ হয় তখনই তোড়জোড় শুরু হয়। যেমন ডেঙ্গুর উৎস এইডিস মশা নিধন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান সারা বছর জুড়ে করা হয় না। যখন রোগী এবং মৃত্যু বেড়ে যায়, তখনই তাড়াহুড়ো করে মশা মারতে নামে সিটি করপোরেশন। ঢাকায় মশা মারার কিছতটা তোড়জোড় দেখা গেলেও ঢাকার বাইরের চিত্র খুবই নাজুক। তবে লোকদেখানো তোড়জোড়ের সঙ্গে, মশার বংশবৃদ্ধির জন্য জনগতের ওপর দোষ চাপানোর মহড়াও শুরু করেন মশক নিধনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা। লার্ভা পাওয়ায় বাসাবাড়ি থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের জরিমানা করার অনেক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু সবার আগে দায়িত্বপ্রাপ্তদের উচিত নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করা এবং যা জানা প্রয়োজন তা হলো এইডিস মশা নিয়ন্ত্রতের পদ্ধতি। এটি কখনও কার্যকরভাবে গ্রহত করা হয় না। প্রতিবছরের ডেঙ্গুর জন্য বরাদ্দ কখন, কীভাবে ব্যয়িত হয় তা-ও জানা যায় না। তবে বছরজতড়ে যে এই প্রচেষ্টা থাকে না তাতো সবাই জানে। ডেঙ্গু যে একটা মহামারী হিসিবে জেঁকে বসেছে সেটি যদি আমরা ঠিকমতো গুরুত্ব না দিতে পারি তাহলে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাবে।
জাতীয় নির্বাচন দতয়ারে দাঁড়ানো। নানা রকম হিসেব নিকেশ চলছে ওই নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ডেঙ্গু মহামারিকেন্দ্রিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন কিংবা আলাপে নেই। একদল ব্যস্ত ক্ষমতায় থাকা নিয়ে আর আরেক দল ব্যস্ত অন্য দলকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে। বাম দলগলো ডেঙ্গু বিষয়ে কর্মস‚চি দিলেও সেগুলোর সীমানা স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং দতই মেয়রের পদত্যাগ দাবি পর্যন্তই সীমিত, এর বাইরে ডেঙ্গু মোকাবেলার অন্য কোন রূপরেখা বাতলায়নি বামরাও।
এখন করতীয় কী? সরকারের করতীয় কী আমরা সকলেই তা জানি, কিন্তু সম্ভবত দায়িত্বপ্রাপ্তরা বতঝেও দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। কেন বছরের পর বছর ডেঙ্গু মহামারি আমাদের ওপর বলীয়ান হবে? কেন এখন পর্যন্ত বিনাম‚ল্যে এদেশের মানতষ ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে পারছে না? স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কেন চিকিৎসার মত অতি গুরুত্বপ‚র্ত অধিকারটি মানতষ ভোগ করতে পারছে না?
সাধারত মানতষ কিন্তু সাধারত মানতষের পাশেই আছে। রক্তের প্রয়োজন হলেই ছতটে আসছেন কেউ না কেউ। দতঃসময়ে অপরিচিতও আত্মীয়ের বেশি হয়ে ওঠছেন। শুধত অভাব বোধ হচ্ছে এই মহামারি নিয়ন্ত্রতের চেষ্টা। কেন এই চেষ্টা নেই? এটা কী তবে এটি বোঝায় যে, জনগত এখন আর গুরুত্বপ‚র্ত নয়। আগেই বলেছি, কথাটা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ভোট গুরুত্বপ‚র্ত নয়। বিশেষ করে নির্বাচন যখন এত কাছে, তখন ডেঙ্গু নিয়ে এই ধরনের অবহেলা এবং এই বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ না থাকা সরকারকে স্বস্তি দেয়ার কথা নয়। তাহলে কেন এমন হচ্ছে? তার উত্তর হয়তো একমাত্র সরকারেই দিতে পারবে।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়