মশা নিধনে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন : উত্তরে নতুন, দক্ষিণে পুরোনো পদ্ধতি

সপ্তাহখানেক ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা নিম্নগামী। ডেঙ্গু রোগীর জন্য বিশেষায়িত ঢাকার ডিএনসিসি হাসপাতালের অর্ধেক শয্যা ফাঁকা। রোগী আসছেও কম। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী শনাক্তের বিভাগ চট্টগ্রামেও রোগী কমছে। তবে ডেঙ্গুর আক্রমণ কয়েক মাস ধরে থাকবে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করছে যথাসাধ্য। তবে প্রশ্ন উঠেছে, ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিধন ও বংশ বিস্তার রোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তর বিশেষ করে, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সিটি করপোরেশনগুলোর পদক্ষেপ কতটা কার্যকর? নগরবিদ, পরিবেশবিদ ও কীটতত্ত্ববিদরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, রাজউক, গণপূর্ত অধিদফতর, রিহ্যাবসহ নানা প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করতে হবে।
ডেঙ্গুকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। মশা নিধনে এ বছর নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করছে তারা। নতুন ওষুধ প্রয়োগ, শিশুদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বই বিতরণ এবং মাঠ পর্যায়ে মশক নিধনে তিন স্তরে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

সূত্র জানিয়েছে, ডিএনসিসি তাদের প্রথম স্তরের পদক্ষেপে প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি কাজ করছে। ওই কমিটি তাদের এলাকায় ঘুরে এডিসের লার্ভার উৎসস্থল চিহ্নিত করবে, লার্ভা ধ্বংসে ব্যবস্থা নেবে, কোন কোন বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে সেই তালিকা করবে এবং কমান্ড সেন্টারের সার্ভারে মশক নিধন কার্যক্রমের ডাটা এন্ট্রি দেবে। দ্বিতীয় স্তরে কাজ করবে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম। টাস্কফোর্স কমিটির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই টিম সেখানে গিয়ে আইন ও নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তৃতীয় স্তরে রয়েছে মেয়রের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং টিম। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের টিমের ভুল বা দায়িত্ব অবহেলার বিষয়গুলোর সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করবে কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিম।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণে নেই নতুন কোন উদ্যোগ। কাজ হোক না হোক, পূর্বের পদ্ধতিতেই মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ওষুধ ছেটানো, অভিযান চালিয়ে বাসা ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে তাদের মশক নিধন কাজ। যে কারণে দক্ষিণ সিটির এলাকাগুলোয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এর কারণ হিসেবে মাঠ পর্যায়ে মশা নিধন কার্যক্রমে দুর্বলতা ও নগরবাসীর অসচেতনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মশক নিধন কর্মী জানান, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে ওষুধ ছিটানোর কাজ। সুপারভাইজাররা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কর্মীদের উপস্থিতি জেনে নেন। অ্যাপের মাধ্যমে হাজিরা হওয়ায় কাজে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে কর্মী সংকটের কারণে চাপ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পুরো এলাকা কাভার করা কষ্টকর। এছাড়া বাসাবাড়িতে মশার ওষুধ ছিটানোর সময় কখনও কখনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কর্মীরা বলেন, সকালে অনেক বাড়ির গেট খুলতে চায় না। অনেকে বাড়ির ছাদে যেতে দেয় না। একবার এলাকা ত্যাগ করলে পরে আর আসার সুযোগ হয় না।

খিলগাঁও এলাকার একজন সুপারভাইজার বলেন, আমার আওতায় ৮ জন কর্মী কাজ করেন। একটি নষ্ট হওয়ায় ৭টি মেশিন দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, বাড়ির মালিকরা যদি পরিষ্কার না রাখে, তাহলে যতই কাজ করি, মশা কমানো যাবে না। এই এলাকা নিচু। একজনের বাড়িতে পানি জমলে সমস্যা হয়। কোনও ড্রেন নাই। এলাকায় ডোবা-নালা বেশি। নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে থাকে। এখানে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার।

তিনি আরো বলেন, এমনও এলাকা আছে যেখানে অল্প জায়গায় দুই ওয়ার্ডের সমান মানুষ বাস করে। কাউন্সিলর অফিস থেকে হেঁটে যেতে লাগে আধাঘণ্টা। তাদের সাইকেলও নাই। আমারও হেঁটে যেতে হয় তাদের পেছন পেছন। প্রত্যেক দিন সবাইকে খেয়াল করা যায় না। দুই-একজনের সঙ্গে যাই। বাকিদের ফোন দিয়ে খোঁজ নিই।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, মশা নিধনে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু যেভাবে ছড়িয়েছে, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা হয়তো কাজ করে কুলাতে পারছে না। প্রত্যেক বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম শতভাগ করা সম্ভব না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে, গৃহায়ণ ও গণপূর্তের যেসব প্রকল্পগুলো চলছে, সেই জায়গাগুলোয় পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজউক, ওয়াসাসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে মশার বংশ বিস্তার রোধে কাজ করলে অনেকাংশই প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

‘এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা লাগে’ জানিয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগরবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি সিটি করপোরেশনগুলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে ওষুধ ছিটানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে নগর পরিকল্পনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে কমিউনিটি পর্যায়ে অংশগ্রহণ জরুরি। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে দীর্ঘমেয়াদে কোনও সমাধান আসবে না। বরং ডেঙ্গু আরও বাড়বে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দিনে এবং রাতেও কামড় দেয়। এই মশা এখন শুধু পরিষ্কার পানিতে নয় যেকোনো পানিতেই জন্মাতে পারে। ডেঙ্গু রোগের লক্ষণও বদলে গিয়েছে, উপসর্গেও পরিবর্তন এসেছে। সবমিলিয়েই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। যেভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে আমরা যদি সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হই তাহলে চলতি বছরে হয়তো ডেঙ্গুর নথিভুক্ত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হবে এবং সেটা কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া ডেঙ্গুতে মৃত্যু এবং আক্রান্তের সরকারি যে হিসাব তাতে সব মৃত্যু ও আক্রান্তের হিসাব যুক্ত থাকছে বিষয়টি তেমন না।

ডা. লেলিন আরও বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলো যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে সকলেরই সমূহ ক্ষতি হবে।

দেশ বর্তমান/এআই