ভোটের সংস্কৃতি যেন ভুলে গিয়েছিলো দেশের ব্যবসায়ী সমাজের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। গত তিন টার্ম শীর্ষ এই ব্যবসায়িক সংগঠনের পরিচালনা পরিষদ থেকে শুরু করে সভাপতি ও সহসভাপতি- কোনো পর্যায়ে ভোট হয়নি। সমঝোতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি হয়েছে পরিচালনা পরিষদ। তবে এবার অতীতের মতো ‘ভোটবিহীন পরিচালনা পরিষদ’ গঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যবসায়ীদের একটি পক্ষ। এফবিসিসিআই পরিচালনা পরিষদ’-এর দ্বিবার্ষিক (২০২৩-২৫) নির্বাচন উপলক্ষে ‘ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ’ ও ‘সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ’ নামে দুটি পৃথক ব্যানারে মাঠে নেমেছে ব্যবসায়ীরা। দুপক্ষই তৎপর। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, অতীতের প্রথা ভেঙ্গে জমবে এবার এফবিসিসিআইয়ের ভোটের লড়াই।
এফবিসিসিআই নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত নির্বাচন বোর্ড ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৩১ জুলাই সংগঠনটির পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন। ওই দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে একটানা ভোট। আগামী ১৮ জুলাই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর পরে জানা যাবে পরিচালক পদে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা এবং ভোটের ময়দানে লড়াই করবেন কারা। তবে পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন এবার বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ। মাহবুবুল আলম ২০১৫-২০১৭ মেয়াদে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ছিলেন। অন্যদিকে এফবিসিসিআইয়ের পাঁচবারের পরিচালক ও ২০১৯-২০২১ মেয়াদের সহসভাপতি মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের প্রতি সমর্থন রয়েছে এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনসহ এক ডজন সাবেক সভাপতির। এছাড়া বিজিএমইএর বর্তমান সভাপতি মো. ফারুক হাসানসহ এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান পরিচালনা পরিষদের একটি বড় অংশ ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদকে সমর্থন জানিয়েছেন। অন্যদিকে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মীর নিজাম উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের সাথে একাট্টা হয়েছেন সংগঠনটির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ, সাবেক সহসভাপতি নিজাম উদ্দিন রাজেশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এক সভাপতি ও আওয়ামী যুব লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য পর্দার আড়ালে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এফবিসিসিআই নির্বাচন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের পক্ষে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে নির্বাচন করার জন্য ৩৯ জন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। মীর নিজাম উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের পক্ষে একই গ্রুপ থেকে নির্বাচন করার জন্য ২৬ জন ব্যবসায়ী মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। এছাড়া পাঁচ জন এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পরিচালক পদে নির্বাচন করার লক্ষে মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। সবমিলে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ৭০ জন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, পণ্যভিত্তিক সংগঠন অর্থাৎ অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ১৯৯০ জন এবার ভোটার হয়েছেন। এসব ভোটাররা অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ২৩ পরিচালক নির্বাচিত করবেন। অন্যদিকে চেম্বার গ্রুপ থেকে ২৭ জন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। চেম্বার গ্রুপে ভোটার ৪৬৯ জন। তাদের ভোটে নির্বাচিত হবে চেম্বার গ্রুপের ২৩ পরিচালক। এছাড়া দুই গ্রুপ থেকে ১৭ জন করে ৩৪ জন সরকার মনোনীত পরিচালক হবেন। আগামী ২ আগস্ট ৮০ জন পরিচালকের ভোটে একজন সভাপতি, একজন জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও ছয় জন সহসভাপতি (চেম্বার গ্রুপ থেকে ৩ জন এবং অ্যাসোসিয়েশান গ্রুপ থেকে ৩ জন) নির্বাচিত হবেন।
এফবিসিসিআই পরিচালনা পরিষদের দ্বি-বার্ষিক নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে কারা থাকছেন তা জানার জন্য আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই দিন প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন এবং বিকালে প্রকাশ করা হবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা। দুই গ্রুপ থেকে ২৩ জন করে ৪৬ জন ছাড়া অন্যরা মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নিলে পরিচালক পরিষদের নির্বাচন হবে না ৩১ জুলাই। তবে চেম্বার গ্রুপের একাধিক নেতা জানান, অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের পরিচালক পদে সরাসরি নির্বাচন হলেও চেম্বার গ্রুপে ভোটবিহীন পরিচালক নির্বাচনের জন্য একটি পক্ষ কাজ করে যাচ্ছেন।
সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানান, তারা একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চান। সাধারণ সদস্যরা ভোট দিতে না পারায় এফবিসিসিআইয়ে যোগ্য নেতৃত্ব আসছে না। সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ ‘আর নয় সিলেকশান, এবার হবে ইলেকশান’, ‘সিলেকশানকে না বলুন’ স্লোগানে মাঠে নেমেছে।
এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ নেতা মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রকৃত ব্যবসায়ীদের এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্বে আনতে আমরা সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ গঠন করেছি। নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালনা পরিষদ গঠন জিবি (জেনারেল বডি) সদস্যদের প্রাণের দাবি। নির্বাচনের লক্ষে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ থেকে ২৬ প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ ও সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের পক্ষে সাধারণ সদস্যদের কাছে যাওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন উভয় ফোরামের পক্ষে বিভিন্ন অভিজাত হোটেল আর ক্লাবে চলছে পরিচিতি সভা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠান। সভায় দুই ফোরামের নেতারা কে কোন্ খাতের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের ভূমিকা রাখছেন সেসব বিষয় তুলে ধরছেন। পাশাপাশি নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পেলে কী করতে চান সে বিষয়ে একটি ধারণাপত্র তুলে ধরছেন। এফবিসিসিআই নির্বাচন নিয়ে নজর রাখছে সরকারও। কোনো সমঝোতা নয়, ভোটের মাধ্যমে সংগঠনের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীরা আসবেন প্রত্যাশা সাধারণ ভোটারদের।
পেছনে ফেরা দেখা: দেশের এই শীর্ষ সংগঠনের নির্বাচন হয় ২৫ মে। এফবিসিসিআইয়ের ২০১৫-১৭ দ্বিবার্ষিক মেয়াদের পরিচালনা পরিষদের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলো নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান মাতলুব আহমাদের নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন পরিষদ। ওই সময় ৩২টি পরিচালক পদে ২৫ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন তার প্যানেল থেকে। এরমধ্যে চেম্বার গ্রুপ থেকে ১২ জন ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ১৩ জন। এছাড়া স্বাধীনতা ব্যবসায়ী পরিষদের ব্যানারে মনোয়ার হাকিমসহ চারজন এবং ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ থেকে তিনজন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এফবিসিসিআইয়ে আংশিক ভোট হয় ২০১৭ সালে। ওই সময় সভাপতি হন শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। পরিচালক পদেও চেম্বার গ্রুপে সকলে বিনাভোটে নির্বাচিত হন। তবে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ভোটে পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ২০১৯ এবং ২০২১ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে।
এমএইচএফ