থমকে আছে আগামীর বন্দর হিসেবে খ্যাত বে-টার্মিনালের নির্মাণ কাজ। এক যুগ আগে বে-টার্মিনাল নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও ব্যক্তি মালিকানাধীন কিছু জায়গা অধিগ্রহণ ছাড়া বাস্তব অগ্রগ্রতি শূন্য। এখনও পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি মাস্টার প্ল্যান। সাত বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি খাস জমি অধিগ্রহণে জটিলতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার পায়রা বন্দর এবং মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রতি যে পরিমাণ স্নেহ দেখাচ্ছে, ততোটা পাচ্ছে না চট্টগ্রাম বন্দর। যার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) এই সর্ববৃহৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গতি পাচ্ছে না। এর সুবিধা পেতে ব্যবসায়ীদের আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ভূমি অধিগ্রহণসহ প্রকল্পের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ থেমে নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রমাগত কনটেইনার বৃদ্ধির কারণে পতেঙ্গা সাগর তীরে বে-টার্মিনাল প্রকল্প নেওয়া হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় আলোচনায় ওঠে আসে আগামীর বন্দর নামে খ্যাত ‘বে-টার্মিনাল’। এই সময়ের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। বন্দরের চেয়ারম্যান বদল হয়েছে পাঁচজন। এই সময়ের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণকাজ প্রকল্প এলাকা নির্ধারণ, কয়েকটি সাইনবোর্ড ঝুলানো এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে তিন দাতা সংস্থার সাথে সমঝোতা স্মারক ছাড়া দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালে পতেঙ্গা সমুদ্র উপকূলে প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উক্ত স্থানে বে-টার্মিনালের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ জার্মানীর সেলহর্ণহামবুর্গ-কেএস জেভি-কে নিয়োগ প্রদান করে। উক্ত প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে কারিগরি এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক এবং উপযোগী বলে মত দেয়। প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল এলাকায় ৬৬. ৮৫ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ২০১৮ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করে। এর বাইওে আরো ৮০৩ একর খাস জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হলেও নানা জটিলতায় তা এখনও অধিগ্রহণ করা যায়নি।
শুরু থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতীকী মূল্যে ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাব করে আসলেও জেলা প্রশাসন আইনি নানা জটিলতা ও সীমাবদ্ধতার কথা বলে আসছে। ভূমির মূল্য ও বরাদ্দ নিয়ে নৌপরিবহন ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দফায় প্রস্তাবনা বিনিময় হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনোটাই পছন্দ হয়নি। সর্বশেষ বন্দর কর্তৃপক্ষ পুনরায় নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দের আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন প্রস্তাবিত খাস ভূমির তিন ক্যাটাগরিতে মূল্য নির্ধারণ করে গত ২৯ জুন ভূমি মন্ত্রণালয়ে নতুন একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ প্রস্তাবনায় ৫০১ একর খাস জমির মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ২৪১ কোটি টাকা। জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় ৫০০ একর নিষ্কন্টক জায়গা রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবিত খাস ভূমির মূল্য প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত উঠলেও সর্বশেষ প্রস্তাবনায় তা এক হাজার ২৪১ কোটি টাকায় নেমেছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান নতুন প্রস্তাবনার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, আমরা মতামতের অপেক্ষায় আছি। জেলা প্রশাসনকে হয়তো তাদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করতে হবে, না হয় প্রতীকী মূল্যে আমরা খাস জমি বরাদ্দ পাবো।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, বে-টার্মিনালের মাল্টিপারপাস বার্থে অর্থায়ন করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া টার্মিনাল-১ এ সিঙ্গাপুরের পিএসএ, টার্মিনাল-২ এ ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং ব্রেক ওয়াটার অর্থায়নের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিশ^ ব্যাংক।বে টার্মিনালের মাস্টার প্ল্যান, ডিটেইল ড্রয়িং ডিজাইন ও নির্মাণ কাজ সুপারভিশন করবে কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডাইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। এর পেছনে বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যয় হবে ১২৬ কোটি ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৬ টাকা।এখনও মাস্টার প্ল্যান চূড়ান্ত করতে পারেনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রণীত প্রাথমিক মাস্টার প্ল্যানের ওপর রয়েছে নানা পর্যবেক্ষণ। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়তে পারে। টার্মিনাল -১ নির্মাণে সিঙ্গাপুর পিএস তৎপর হলেও অপর টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ ব্যক্তকারী সংস্থা দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডের নড়াচড়া নেই। তবে বে-টার্মিনালকে বৈরি আবহাওয়া এবং সাগরের বড় ঢেউ থেকে রক্ষা করতে ডুবোচরে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে যেভাবে বে-টার্মিনালের কাজ এগোচ্ছে তাতে ২০২৬ নাগাদ এটির অপারেশনাল কাজ শুরু করা যাবে কিনা তাতে সংশয় প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম বন্দরেরর প্রধান স্টেকহোল্ডার বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আলাপচারিতায় দেশ বর্তমানকে বলেন, সরকার পায়রা বন্দর ও মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরকে যেভাবে গুরত্ব দিচ্ছে এর চেয়ে বেশি গুরত্ব দিতে হবে বে-টার্মিনাল নির্মাণের ওপর। এটাকে কোনোভাবে অবহেলা করা যাবে না। কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বে-টার্মিনালের অগ্রগতি থমকে যাক, এটি আমাদের কাম্য নয়। আমরা চাই এর দ্রুত বাস্তবায়ন।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বে-টার্মিনালের কাজ থেমে নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতা সংস্থাগুলো দফায় দফায় বৈঠক করছেন। কনসালটেন্ট নিয়োগ, সম্ভাব্যতা যাচাই, ডিপিপি তৈরিসহ প্রকল্পের প্রাথমিক কাজগুলো পুরোদমে চলছে। তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতাও সহসা মিটে যাবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে ৯ মিটার গভীরতা ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে বড় জাহাজ প্রবেশ করতে পারে না এবং জাহাজ ভেড়ানোর ক্ষেত্রে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করতে হয়। বে-টার্মিনালে ১২ মিটার গভীরতা ও ২৮০ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়তে পারবে । ভেড়ানোর ক্ষেত্রে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করতে হবেনা।