কোভিড-১৯, করোনা শব্দটি এখন আতঙ্ক-উদ্বিগ্ন ভীতি-ভয়, ঘাবড়ানি-দাবড়ানির নাম। আচমকা আবির্ভাব হয়ে গেল প্রায় দুই বছরাধিকাল সময়ে দেশের প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে চাক্ষুষ মোক্ষধামে পাঠিয়েছে। বৈশ্বিক সংহারীর এই ত্রাস করোনায় হতবিহবল হতবুদ্ধি হয়ে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ এর বিপরীতে সমীহ করা এক আশ্চর্যজনক নীরব ঘাতক যক্ষা । করোনাকালীন দুই বছরে দেশের এক লাখ বাইশ হাজার ভয়বিহবলহীন মানুষকে মৃত্যুর কোলে টেনে নিয়েছে। প্রতিদিন ১৮০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিষ্ঠাবান গবেষণায় বিপদসংকেত ধ্বনির এই রহস্য উম্মোচিত হয়েছে। যক্ষা সংক্রান্ত সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতির সর্তকবার্তায় অত্যধিক প্রকোপ মোকাবেলার ২২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। বছরে সারাদেশে প্রায় ৩লাখ যক্ষাক্রান্ত রোগীর শনাক্ত প্রক্রিয়া সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়। সন্দিহান উপসর্গ নিয়ে ভীরুতা বর্জন করে সমাজের সাথে মিশে ঘুরাফেরা করে আরো ২৭ লাখ মানুষ।
বর্তমান আতঙ্কগ্রস্থ চিকিৎসা পরিস্থিতির মধ্যেও যক্ষা রোগ নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় ৪ লাখ রোগী । শনাক্ত হওয়া মোট রোগীর ৮১ শতাংশ চিকিৎসা বলয়ের ধারেকাছে থাকে, বাকী ১৯ শতাংশ রোগী সু-চিকিৎসা প্রকৃত চিকিৎসার পরোয়া করে না। “যার হয় যক্ষা তার নাই রক্ষা” আমাদের সমাজে প্রচলিত এই আপ্তবাক্যটি মানুষের মনোভূমিতে এখনও গেঁথে আছে। সামাজিক অবহেলা আর আক্রান্ত ব্যাক্তির অস্পৃশ্য থাকার চিন্তার ফসল এই রোগের জটিলতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় তাৎপর্যপূর্ণ এই রোগের কারণ ও সুনির্দিষ্ট জীবাণু আবিষ্কার করা গেছে। উদ্ভাবিত হয়েছে অত্যধিক ছোঁয়াচে জটিল এই সংক্রামক ব্যাধির আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। মানবকল্যাণে নিয়োজিত ওষুধবিজ্ঞানীদের তাত্তি¡ক আকুতি ক্রমশ গতিশীল হয়। আবিস্কার হয় পরিবর্তনশীল নিত্যনতুন সব ওষুধপত্র ক্রমপরিবর্তনশীল এই রোগের গতিপ্রকৃতির দিগন্তরেখা নিয়তই সর্বাধুনিক হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি আর বহুমাত্রিক ওষুধ ব্যবহারের ফলে মানুষে রোগে দূরত্ব দ্রæতই কমে আসছে। তারপরও যক্ষার জটিল কিছু প্রকারের উদ্ভাবন, আমাদের অজ্ঞতা, কিছুটা প্রযুক্তিগত অব্যবস্থাপনা এবং সচেতনতার অনুষঙ্গ হিসাবে চিকিৎসার আওতাধীন ৬ শতাংশ রোগীকে পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য করা সম্ভব হয়না।
২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ । দুর্ভাগ্যজনকভাবে জীবন কোরবানি দেওয়া এইসব মানুষের প্রায় অর্ধেক ভারতীয় উপমহাদেশের। আক্রান্তের ক্ষেত্রেও আমাদের মাথার উপর বেসামাল ছড়ি ঘোরায় এই জীবাণু, ওই একই পরিসংখ্যানে। বাতাসের সাথে সখ্যতা গড়া মাইকোব্যক্টরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামের এক প্রতাপশালী ব্যাকটরিয়া খুব সহজেই শরীরের ভেতর ঢুকে যেতে পারে। বাতাসের সাথে ঢুকে বলে প্রথমেই আমাদের শ্বাসযন্ত্র ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। তবে য²া মানেই ফুসফুস তা নয়। বায়ুবাহিত এই জীবাণু মানবদেহের যেকোন অঙ্গকেই সংক্রমিত করতে পারে। আমাদের দেহের প্রতিরোধ সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মাস্তিষ্ক,ত্বক, অন্ত্র, লিভার, কিডনি, হাড়সহ সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঘটাতে সক্ষম আক্রমণ।
অর্থাৎ মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত আক্রমণের শিকার হতে পারে। জন্মগতভাবেই যক্ষার জীবাণু বহন করে অনেকে স্বাভাবিক জীবনধারণ-জীবনাচার চালিয়ে যেতে পারেন। জীবাণুর ধারক হলেও উক্ত ব্যক্তিকে য²াক্রান্ত বলা যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত এই জীবাণু অন্যকে আক্রমণ করতে না পারে, কারো শরীরে ছড়াতে না পারলে ততক্ষণ নিষ্ক্রিয় থাকে । বলা হয়ে থাকে নিষ্ক্রিয় যক্ষা জীবাণু বহনকারীর সংখ্যাও আমাদের সমাজে নেহায়েত কম নয়। রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতায় দুর্বল ব্যাক্তি খুব সহজেই এই জীবাণুর আক্রমণে কাবু হয়ে যেতে পারে। নোংরা দূষণ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ , অপুষ্টি, দরিদ্র্যতা, মাদকের আসক্তি ব্যক্তিদের আক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ভীষণ ছোঁয়াছে এই জীবাণু হাঁচি,কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে খুব দ্রæত একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে ঘায়েল করতে পারে।
যাদের ডায়াবেটিস , ক্যান্সার, হার্টডিজিজ, কিডনি রোগ, প্রেসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত এবং অপুষ্টির শিকার ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা অন্যদের তুলনায় খুব সহজেই এই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। সারসংক্ষেপ হিসাবে বললে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ধারণা করে সারা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সুপ্ত যক্ষায় আক্রান্ত । চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম ‘ল্যাটেন্ট টিবি’। এখান থেকে ১০ শতাংশ মানুষ আবার যেকোন সময় সুপ্ত থেকে সক্রিয় রোগের বাহক হয়ে যেতে পারে ।
অনবদ্য প্রাণোদ্দীপ্ততায় উদ্ভাসিত হয়ে যক্ষার পূর্ণ লক্ষণে সংক্রামক হয়ে ওঠে। সক্রিয় যক্ষার পরশে মানবদেহের জীবনাচারে ব্যাপক পবিবর্তন ঘটে। ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ফুসফুসে আগ্রাসন হয়ে থাকে বলে কাশির সাথে বেশ সখ্যতা হয়। শুকনো কিংবা কফযুক্ত কাশির সঙ্গে রক্ত যেতেও পারে নাও পারে। সতর্ক অবস্থানে বাস্তববাদী ধারায় সহজভাবে তা যদি হয় এক নাগারে তিন সপ্তাহ তবে আশংকার মাত্রা গাণিতিকহারে বেড়ে যায় । অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, অবসাদ, সন্ধ্যায় হালকা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, রাতে ঘাম, পেটে ব্যাথা, লাসিকাগ্রন্থি ফুলে গেলে-স্ফীতি হলে, মলত্যাগের অভ্যাস পবিবর্তন হলে, খিঁচুনি হলে, মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হওয়া এইসমস্ত উপসর্গ দেখা দিলে আর দেরি নয়। বুঝতে হবে যক্ষার জীবণু শরীরে বশীভূত হয়েছে।
এতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের দেশে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে উপজেলা হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসাপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতালসহ প্রায় ৭ শতাধিক হাসপাতালে বিনামূল্যের অল্পকয় পরীক্ষার মাধ্যমে এই যক্ষা রোগ নির্ণয় সম্ভব । বর্তমানে সর্বাধুনিক জিন এক্সপার্ট মেশিনসহ আধুনিক সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সজ্জিতকরণ করে ব্র্যাকসহ অন্তত ২৬ টি বেসরকারি সংস্থা এনজিও স্বেচ্ছাসেবী এই যক্ষা নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। হাসপাতাল কেন্দ্রীকতা পরিহার করে দেশে প্রায় ৫০০ স্থানে জিন এক্সাপার্ট মেশিন, ১২শত অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণযন্ত্র ও দেড় শতাধিক স্থানে ডিজিটাল এক্স-রে ব্যবস্থা গডে তলেছে তারা। সরকারও কম যায় না। হায়ার করা এনজিও ছাড়াও সরকার এই খাতে ৫ বছরের জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে কাশির পরীক্ষা এবং নিরাময়ে ৬ মাস, ৯ মাস মেয়াদি ওষুধ নিয়ে রোগীদের ভাবনা চিন্তা করা লাগে না।
সরকার-সংস্থা-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের যক্ষা চর্চা অনুশীলন জোরদার করে নিরাময়ে অসামান্য অবদান রাখছে। ওষুধ প্রতিরোধী জটিল অবস্থায় খরচাধিক্যের পর্যায়ে গেলেও সাহায্য সহাযোগিতার আদান প্রদানে প্রভূত সহায়তা করে থাকে। অনিয়মিত ওষুধ সেবন, রোগ গোপন করা, ওষুধ না খাওয়া, অসচেতনা, অসতর্কতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার পাদপ্রদীপের নীচে আটকা পড়লে, মারাত্মক আকার ধারণ করে জীবনসংহারী এই যক্ষা। ওষুধে তখন বশীকরণ সম্ভব হয় না। চিকিৎসা সফলতার আওতাবর্হিভূত থাকে । সারা গায়ে, বুকে, মুখে, হাতে-পায়ে, ঘাড়-গর্দানে, চুলে-ফুলে যে স্থানে এই দানবীয়শক্তির যক্ষা হোক চিকিৎসা সুবিধার বাধ্যবাধকতার কারণে তাকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ফুসফুসের যক্ষা আর ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষা।
মানবদেহে একটার পর একটা চিহ্ন জাগিয়ে ভয়-ভীতি দুঃসংবাদ জাগিয়ে এদের আবার ভাগ-উপভাগে নামকরণ করা হয়। অবস্থান আলোকপাত করে ‘রাজক্ষয়’ এই রোগের সুবিবেচনাপ্রসূত চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন চিকিৎসকগণ। চলমান ধারাবাহিক উন্নতির আকাঙক্ষা নিয়ে দিনক্ষণ নির্ধারণ করে ধনী-গরিব সবাইকে, সব রোগিকে সপরিষদ চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় ভিড়ানোর চেষ্টা করেন। চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার মাঠ গরম করা এই রোগ নির্মূল ও বৈশ্বিক পর্যায়ে ২০৩৫ সালকে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বে মৃত্যুজনিত দশটি কারণের মধ্যে অন্যতম যক্ষা যেন কপালে আবার বলি রেখা বাড়াতে না পারে এইজন্য সবাই একত্রে এক অপরের সুখ-দুখের ঠাসবুনুনি হয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে লাখে ৫৪ জন মারা যেতো ২০২০ এসে তা ২৪ জনে ঠেকেছে।
মৃত্যু উসকানি দেওয়া এই যক্ষার আণ্ডাগণ্ডাসহ মূল উপড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা আর আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা ২০৩৫ সাল। লজ্জায় মুখ না লুকিয়ে সবাই মিলে চিন্তা করি বেটার লেট দ্যান নেভার। মানবসভ্যতার ইতিহাসে দুরারোগ্য দুর্ভেদ্য দুর্দমনীয়, প্রাণসংহারী এই অতি প্রাচীন রোগ যক্ষা নিয়ন্ত্রণে আসে ১৮৮২ সালের পর থেকে। বিজ্ঞানী রবার্ট ১৮৮২ সালে যক্ষার জন্য দায়ী ব্যাকটিরিয়া প্রজাতিটির যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। ঢালতলোয়ারবিহীন কিংবদন্তির এই আবিষ্কারের পর যক্ষা নাবালকত্ব অতিক্রম করতে থাকে। রোগে নির্ণয় ও রোগ নিরাময়ের পথ উম্মোচিত হয়। ১৯০০ সালে পান্তুর ইনস্টিটিউট যক্ষা জব্দের টিকা আবিষ্কারে মনোনিবেশ করে।
জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথম বিসিজি টিকা মানবদেহে উৎসবমুখর পরিবেশে ব্যবহার করা হয়। সদ্যোজাত ভুমিষ্ট শিশুদের এই টিকা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার সারবত্তা হিসাবে এই জীবাণুর গুমোট আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ত্রুটি ব্যত্যয় পরিহার করে একশত বছর ধরে এই টিকা ব্যবহারের সূত্রমুখ খুলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী রবার্ট ২৪ মার্চ ১৮৮২ সালে। এর ঠিক শত বছর পর ১৯৮২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৪ মার্চকে আন্তর্জাতিক যক্ষা দিবস ঘোষণা করে। এই দিবসের শ্রদ্ধাবোধ শিকের তুলে রেখেছিল বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য সচেতন কর্মসূচির সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ, এনজিও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সভা-সেমিনার পথসভা, র্যালি, প্রবন্ধ প্রকাশনা, প্রদর্শনির মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। প্রতি বছর সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে চলে এর ধারাবাহিকতা।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী