বিশ্বের যোগাযোগের হাব হবে বাংলাদেশ: প্রধানমন্ত্রী
* পিছিয়ে থাকবো কেন- আমরাও চাঁদে যাবো ‘স্বপ্নের চেয়েও থার্ড টার্মিনাল বড় প্রকল্প’ আকাশ পথে তৈরি হবে ২৫০০ নতুন পথ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে একসময় বাংলাদেশই হবে সারা বিশ্বের যোগাযোগের হাব। কক্সবাজার বা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এটাই হবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনের হাব। সেটাই আমরা বিশ্বাস করি। সেভাবেই আমরা তৈরি হচ্ছি। গতকাল শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
বিভিন্ন সময়ে আকাশপথে যোগাযোগের রুট পরিবর্তন হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা দেখেছেন, একসময় আন্তর্জাতিক হাব ছিল হংকং। এরপর হলো সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড; এখন দুবাই। আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমাদের কক্সবাজার বা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হবে আন্তর্জাতিক হাব। রিফুয়েলিংয়ের জন্য অনেকেই এখানে আসবে, থামবে; বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। আর কক্সবাজারে নামলে তো আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ বালুকাময় সি বিচ সেটাও সবাই উপভোগ করতে পারবে। সেভাবেই আমরা সব কিছু গড়ে তুলতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তি সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলে মানুষের যোগাযোগ সহজ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন সবকিছু উন্নত করার ব্যবস্থাই তার সরকার করবে। ঝরঝরে বিমানের যুগ পেরিয়ে এখন বিমানের বহরে ২১টি অত্যাধুনিক বিমান যোগ হয়েছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছে। তাছাড়া এই তৃতীয় টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে আমাদের আড়াই হাজার নতুন পথ সৃষ্টি হবে।
দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে সরকার বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে লালমনিরহাটে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেখি আমাদের আশপাশের দেশ চাঁদে চলে যায়। তাই আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো, আমরাও চাঁদে যাবো। ভবিষ্যতে সেভাবেই আমরা স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলবো।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল; এ সময়টাই বিমানবন্দরের উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, যদি পারেন, ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত কী উন্নয়ন ছিল, সেটা একটু দেখবেন। ১৯৯৬ সালে আমি যখন সরকারে আসি, তখন আমাদের বিমানবন্দরের কোনও বোর্ডিং ছিল না, পার্কিং লোড ছিল না; কিছুই ছিল না। আমরা সরকারে এসেই বিমানবন্দরের উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম এবং সিলেট এই দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও আমরা নির্মাণ করি। সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরের উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করি।
মানুষের যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, আধুনিক যুগের নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের সঙ্গে সঙ্গে আকাশপথও অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যে যোগাযোগ, তার মূল বাহন হচ্ছে বিমান। অর্থাৎ আকাশযাত্রাটা হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেটাকে গুরুত্ব দেই।
বিমানবন্দরের আধুনিকায়নের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আরও পর্যাপ্ত আধুনিক, সুযোগ-সুবিধা যাতে করে সৃষ্টি হয়, সে জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। কারণ, আমাদের দেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা বসবাস করে। তারা বিভিন্ন দেশে কাজ করে, রেমিট্যান্স পাঠায়। তারাও যাতায়াত করে।
এর আগে শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে নবনির্মিত টার্মিনাল তিন পরিদর্শন করেন। এসময় বাংলাদেশ বেসামারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান নতুন এই টার্মিনালের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘুরিয়ে দেখান। এসময় বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তারা তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
নতুন টার্মিনালে অটোমেশন সিস্টেমে কীভাবে বোর্ডিং পাস হবে, তাও করে দেখানো হয়। এসময় প্রধানমন্ত্রীকে একটি ডামি বোর্ডিং পাসও দেয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ইমিগ্রেশন কাউন্টারও পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে তিনি ‘প্রি-বোর্ডিং সিকিউরিটি স্ক্যানিং’ জোনে যান। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বোর্ডিং ব্রিজে। এসময় তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের বিভিন্ন স্থিরচিত্র দিয়ে সাজানো একটি ফটোগ্যালারি পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মঞ্চে যান। এসময় মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, জাপান সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদী ভাইস মিনিস্টার মাশাহিরো কুমুরা, জাপান সরকারের ভূমি অবকাঠামো ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ইয়োহারা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ঢাকা ১৮ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসান, সামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন ও বাংলাদেশ বেসামারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান প্রমুখ। এসময় দর্শক সারিতে প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সংসদ সদস্যসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।
বেবিচক জানায়, তৃতীয় টার্মিনাল তিন তলা বিশিষ্ট। টার্মিনালের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গ মিটার। যাত্রী ধারণ সক্ষমতা হবে বছরে ১৬ মিলিয়ন। তৃতীয় টার্মিনালের কার পার্কিংয়ে ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। উড়োজাহাজ পার্কিং বে থাকবে ৩৭টি। আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গটার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে ছয়টি চ্যানেল থাকবে। চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকছে ১২৮টি। এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয় ইমেগ্রেশন কাউন্টার ১৫টি। বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি। আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি। ভিভিআইপি ৩টি। বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে প্রথম পর্যায়ে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত করা হবে। বর্তমান টার্মিনাল দুটির সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনও সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে করিডোর নির্মাণ করা হবে।
স্বপ্নের চেয়েও বড় এই প্রকল্প- বেবিচক চেয়ারম্যান: বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেছেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়। প্রধানমন্ত্রীর এভিয়েশন হাব করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। স্বপ্নের চেয়েও বড় এই প্রকল্প। আজ আমাদের গর্বের দিন। আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন। অনেক বাধা আমাদের পার হতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তিনটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো মেনে তৃতীয় টার্মিনাল স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে ১২ এয়ারলাইন্স: বাংলাদেশের সঙ্গে আকাশ পথে সংযুক্ত হতে আগ্রহী অন্তত ১২টি বিদেশি এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে কিছু-কিছু এয়ারলাইনস বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে, কেউ-কেউ মৌখিকভাবে জানিয়ে রেখেছে। তবে, স্থান সংকটের জন্য নতুন করে কোনো এয়ারলাইন্সকে আপাতত ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেবিচক।
বেবিচক সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশের অন্তত ১২টি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বেবিচকে যোগাযোগ করেছে। অতি সম্প্রতি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা এয়ারলাইন্সগুলো হচ্ছে- শ্রীলঙ্কার ফিটস এয়ার, দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এয়ার, আবুধাবিভিত্তিক উইজ এয়ার, ইন্দোনেশিয়ার গারুদা ইন্দোনেশিয়া, ইরাকের ইরাকি এয়ারওয়েজ, জর্দানের রয়াল জর্দানিয়ান, ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স, এয়ার ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ।
ইতোমধ্যে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পেয়েছে আফ্রিকাভিত্তিক উড়োজাহাজ সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স। তারা ২০২২ সালে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়েছিল। চলতি বছরের অক্টোবরে তারা বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার ঘোষণা দিতে পারে।
এয়ারলাইন্সটি দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকান দেশগুলোতে বসবাসরত বাংলাদেশি যাত্রীদের ইথিওপিয়ায় ট্রানজিট দিয়ে অল্প সময়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দিতে চায়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এয়ারলাইন্সগুলো এই রুটের যাত্রী বহন করছে।
আবেদন করা এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে উইজ এয়ারকে বেবিচকের পক্ষ থেকে আপাতত ফ্লাইট পরিচালনার ‘অনুমতি দেয়া যাচ্ছে না’ বলে জানিয়ে দিয়েছে বেবিচক। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছিল বেবিচক।
উইজ এয়ার চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুবাই রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে চেয়েছিল। ভবিষ্যতে বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়লে (তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে) তাদের ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
বেবিচকের কাছে সর্বশেষ আবেদন করে শ্রীলঙ্কার ফিটস এয়ারের। ঢাকা থেকে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো রুটে সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়েছে এয়ারলাইন্সটি। তবে অ্যাপ্রোন এয়ারক্রাফট রাখার স্থান সংকট থাকায় আপাতত তাদের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না।
এসব এয়ারলাইন্স ছাড়াও বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য মৌখিকভাবে জানিয়েছে আরও অন্তত ৪টি এয়ারলাইন্স। এগুলো হচ্ছে- পাকিস্তানের পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ), উজবেকিস্তানের উজবেকিস্তান এয়ারওয়েজ, সুইজারল্যান্ডের সুইস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স ও সৌদি আরবের রিয়াদ এয়ার। এদের মধ্যে পিআইএ ২০২২ সালে বেবিচককে ফ্লাইট পরিচালনার কথা জানায়। বেবিচক তাদের আবেদনের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয় বলে জানা গেছে। বাকি ৩টি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতদের দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীর কাছে ফ্লাইট পরিচালনার আগ্রহের কথা জানায়।
বেবিচক জানিয়েছে, থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হলে একসঙ্গে মোট ৩৭টি প্লেন রাখার অ্যাপ্রোন (প্লেন পার্ক করার জায়গা) হয়ে যাবে। তখন একে একে অনুমতি পাবে সবাই। পৃথিবীর ১৭২টি দেশে অন্তত ১ কোটির বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী ও শ্রমিক বৈধভাবে কাজ করছেন। সেসব শ্রমিকদের দেশে আনা-নেয়া করার জন্য পর্যাপ্ত ফ্লাইট নেই বাংলাদেশের দুটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের। এর ফলে সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো।