আগামী নির্বাচন নিয়ে কূটকনৈতিকদের খবরদারি বেড়েই চলছে। যুক্তরাষ্ট্র সহ বড় বড় দেশ গুলো বিশেষ করে আমাদের উন্নয়ন সহযোগি দেশ ও সংস্থার প্রধানগন বাংলাদেশে বার বার আসা যাওয়া করছেন এবং নানা কথা তারা বলে যাচ্ছেন। এসব কথা কার পক্ষে গেলো বা কার লাভ,কার ক্ষতি হলো তা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বাহাস শুরু হয়ে গেছে। এ বাহাসে কার জিত কার হার তা নিয়েও দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাম্বাসেডরদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণম‚লক দেখতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আওয়ামী লীগও চায় একটি ভালো, ত্রুটিমুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন। তবে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে বিএনপি ক‚টকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। ২০১৩-১৪ সালের মতো আবারো আগুন সন্ত্রাসের উপর ভর করে সরকার উৎখাত ও দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে ক্ষমতা দখলের পায়তারা করছে।
তিনি আরো বলেন, বিএনপি সংলাপে বিশ্বাস করে না। রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশনের সংলাপে তারা যায়নি। আর আওয়ামী লীগ কারো নির্দেশনা শোনে না, সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে। তিনি বলেন, বিএনপি দূতাবাসে চুপিচুপি আসে, কাউকে জানায় না। আওয়ামী লীগ আমন্ত্রণ পেয়ে এসেছে। সবাইকে জানিয়েই এসেছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ভূমিকা পালন করবে। শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
উল্লেখ্য এ বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাতটি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
একই দিন দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ভবনে স্বাধীনতা হলে এক নাগরিক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘এখন একজন মার্কিন ক‚টনীতিক ঢাকায়। তিনি যখন সরকারের সঙ্গে কথা বলেছেন, তখন পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন- যে দেশে গণতন্ত্র নিম্নগামী থাকবে, নিচের দিকে চলে যাবে, তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও নিম্নগামী হবে, সহযোগিতা কমে আসবে।
বুধবার বিকেলে রাজধানীর আমেরিকান সেন্টারে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সফররত মার্কিন কুটনীতিক ডেরেক শোলে বলেন, ‘বিশ্বের শক্তিশালী গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। বিশ্বের যেকোনো দেশে গণতন্ত্র সংকুচিত হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা সীমিত করে নেয়। এর মানে এই নয় যে আমরা সহযোগিতা করব না। এর মানে এটাও নয় যে আমাদের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ নয়। সম্পর্ক সীমিত করার বিষয়টি বিবেচনায় আসে ব্যবসা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।’
এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, ‘এগুলো সবচেয়ে কঠিন কথা। মানবাধিকার প্রশ্নে কোনো আপোষ নাই বলেছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যতীত কোনো গণতন্ত্র চলতে পারে না। এই কথাগুলো ঢাকায় বসে তিনি বলেছেন। কত অপমানকর!’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা তাদের পকেটে চলে গেছে। এজন্য বাংলাদেশের মানুষ যেমন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে, তেমনি বিশ্ববাসী, বিশ্ববিবেক প্রতিবাদ করছে। এই প্রতিবাদ বাংলাদেশে যেমন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, বিশ্ববাসীও জোর করে ক্ষমতায় যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।’
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন নিয়ে কথা বলাতে বিএনপির কোনো আগ্রহ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, যারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে রয়েছেন, তারা নিজেরাই অবৈধ। কারণ, বর্তমান সরকার নির্বাচিত নয়।’ এখন সরকার পতনই বিএনপির মূল লক্ষ্য বলে জানান বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।
প্রসঙ্গত,গত বুধবার একই দিনে ঢাকায় তিন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকরা বাংলাদেশে এসে সরকারের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে গেছেন। তিন কূটনৈতিক হলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জাং সঙ মিন ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোত্রা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্যদের উর্দ্ধতন কর্মকতাদের সাথে বৈঠক করেছেন।
এসব বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচন নিয়েও গুরুত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ কর্মকর্তা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কখনই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না। অন্যদিকে ডেরেক শোলে সাংবাদিকদের বলে গেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। এ জন্য আমি বাংলাদেশে এসেছি। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আবার এ সফর নিয়ে গত বুধবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বৈঠকগুলোতে কাউন্সেলর শোলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকারের সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে সহযোগিতা ও একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
কাউন্সেলর শোলে বলেন, বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত ফলপ্রস‚ হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির পর পরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসে আমি সম্মানিত বোধ করছি। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব রয়েছে, যা কয়েক দশকের সহযোগিতা ও সমর্থনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের উভয় দেশের জন্য আরও বেশি স্থিতিশীল, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা ও মানবিক সহযোগিতার পূর্ণ সম্প্রসারণের পাশাপাশি দুই দেশের জনগণের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলার জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে চলেছে।
এদিকে কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বুধবারের বৈঠকটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ থেকে দিল্লিতে শুরু হওয়া জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সূত্র জানায়, দিল্লি সফরে শুধু জি-২০ সম্মেলনেই অংশ নেবেন না, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিটি শীর্ষ বৈঠকেই দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। এজন্য লম্বা প্রস্তুতি নিতে হয়। মূলত মোমেন-বিনয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে সেই প্রস্তুতিই শুরু হলো। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে এ-সংক্রান্ত আরও আট থেকে দশটি বৈঠকের মধ্য দিয়ে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ-ভারত শীর্ষ বৈঠকের জন্য চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হবে।
একই দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোত্রা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তার দেশের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ উন্নয়ন যাত্রায় ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বন্ধনকে অত্যন্ত দৃঢ় বলে বর্ণনা করে বিনয় কোত্রা বলেন, সমগ্র বিশ্ব এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে, যা ইতোমধ্যেই কৌশলগত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জাং সঙ মিন ঢাকা সফরের একপর্যায়ে স্থানীয় একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য রাজনৈতিক পর্যায়ে আরও যোগাযোগ বাড়াতে হবে, সহযোগিতা বাড়াতে হবে। দুই দেশ কে, কী চিন্তা করছে সেটা একে অপরকে জানাতে হবে। এটাই দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্টের দর্শন। এজন্য তিনি আমাকে বাংলাদেশ পাঠিয়েছেন। প্রযুক্তিতে দক্ষিণ কোরিয়ার বড় অগ্রগতি আছে জানিয়ে এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশ-কোরিয়ার সবেচেয়ে বেশি কার্যকর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।
নিজের সফরকে সম্পর্কের নতুন সূচনা হিসেবে অভিহিত করে জাং সঙ মিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষিণ কোরিয়া সফরের বিষয় কূটনৈতিক পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব। আমাদের বিবেচনা, সামনের বছর নির্বাচনের পর দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গেলে বিষয়টি আরও ভালো হবে।
কূটনৈতিকদের নানা বক্তব্যকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা বক্তব্যেও যে অংশ যার পক্ষে নেতারা সেই অংশের বক্তব্য নিয়ে সভাসমাবেশে দলীয় অবস্থান তুলে ধরছে। ফলে রাজনৈতিক সচেতন মহল বিষয়টির প্রতি বেশ নজরও রাখছেন।
বামপন্থী এক রাজনৈতিক বলেন, বড় দেশ গুলোর পক্ষে আমাদের দলগুলো কার ছেয়ে কে বেশি দালালী করতে পারে তারা সেই প্রতিযোগিতা করছে। আমাদের ভালোয় লাগছে। আমরা বড় দল গুলোর এ প্রতিযোগিতা উপভোগ করছি।