চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের শীলপাড়ায় চাঞ্চল্যকর ১১ (এগারো) হত্যার বিশ বছর পেরিয়ে গেল। ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর একই পরিবারের ১১ জন সংখ্যালঘুকে রাতের আঁধারে বাইরে থেকে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারার ২০ (বিশ) বছর অতিবাহিত হলেও আজো বিচার মেলেনি
।
জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধ বিষয়ে এই পরিবারকে পুড়িয়ে মারা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেদিনের ঘটনায় ৭২ বছরের বৃদ্ধ থেকে চার দিন বয়সী শিশু সহ ১১ জন সদস্য মৃত্যুবরন করে। ঘরের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বেঁচে যাওয়া বিমল শীল দ্বারে দ্বারে ঘুরছে বিচার পাওয়ার আশায়।
সেদিনের ঘটনায় নিহতরা হলেন একমাত্র বেঁচে যাওয়া বিমল শীলের পিতা তেজেন্দ্র লাল শীল(৭০) মা বকুল শীল (৬০) বড় ভাই অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল(৩০), অনিলের সন্তান রুমি শীল(১২), সোনিয়া শীল(৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল এবং বিমলের চাচাত বোন বাবুটি শীল (২৪), প্রসাদি শীল (১৭), এ্যানি শীল( ৭) সহ কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয় দেবেন্দ্র শীল(৭২)। বিমল শীলের ২ (দুই) ভাই সুনীল শীল ও নির্মল শীল ওই রাতে বাড়ীতে না থাকায় বেঁচে যায়।
সাধনপুরের ১১ সংখ্যালঘু পুড়িয়ে মারার ঘটনায় একমাত্র জীবিত সদস্য বিমল শীল বাদী হয়ে মামলা করেন। ঘটনার প্রায় (২৫)পঁচিশ মাস পর পুলিশের অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আমিনুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে জমা দিলে বাদী নারাজি দেন। এভাবে চতুর্থ দফা শেষে ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারী পুনঃতদন্ত করে সিআইডি প্রধান অভিযুক্ত বিএনপি নেতা আমিনুর রহমান সহ ৩৯ জনকে আসামী করে রিপোর্ট জমা দেন। তম্মধ্যে এক জনের নাম প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমানে ৩৮ আসামীর ১(এক)জন কারাগারে, ১৮ জন জামিনে থাকলেও অন্যরা পলাতক রয়েছে। মামলার এতদিন পরও সাক্ষ্য গ্রহন শেষ হয়নি। গত ২০ বছরে চার্জশীট অনুয়ায়ী ৫৭ জন সাক্ষীর মাত্র ২৭ জনের সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়েছে । বারংবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা সহ ৩০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হয়নি। গত ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহনের দিন ছিল। এতে সাক্ষীগন উপস্থিত না হওয়ায় চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এইচ এম শফিকুল ইসলামের আদালতে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং পুলিশ সুপারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের নির্দেশনা দেয়া হয় এতদসঙ্গে পরবর্তী শুনানী তারিখে সাক্ষীদের হাজির করতে বলেছে আদালত। সর্বশেষ গত ৯ নভেম্বর শুনানির দিন থাকলেও সাক্ষী দিতে কেউ না আসায় ৮ এপ্রিল ২০২৪ পুনঃশুনানির তারিখ নির্ধারন করেছে আদালত।
চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, মামলাটি বেশ পুরোনো হওয়ায় সাক্ষীরা অনেকেই সাক্ষ্য দিতে আসেনা। মুলত সাক্ষীদের হাজির করতে না পারায় মামলাটি ঝুলে আছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়ে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।
মামলার বাদী বিমল শীল এবং তার ভাই সুনীল শীল, নির্মল শীল ঘটনার পর থেকে পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে চট্টগ্রামে বসবাস করছে। বিচারের আশায় এখনো হন্যে হয়ে ঘুরছে। বিশ বছর ধরে বিচারের দাবীতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বিমল শীল এক প্রকার বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে। তিনি বলেন- শুনানীর দিন ছাড়াও মামলার খোঁজ নিতে আদালতে যাই, জানিনা নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার আদৌ পাব কিনা? স্বজনদের স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাড়িয়ে তাদেরকে জবাব দিতে পারিনা। সাধনপুর শীলপাড়াস্থ বসত ভিটায় নিহতদের সমাধিস্থ করা হয়েছে। সমাধিস্থলে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করা হয়েছে। প্রতিবছর নিহতদের সমাধিতে ফুল দিয়ে স্মরন করা হয়।
শনিবার ( ১৮ নভেম্বর) ফুল দিতে পরিরবারের সদস্যদের পাশাপাশি উপস্থিত হন চট্টগ্রাম দক্ষিন জেলা আওয়ামীলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক খোরশেদ আলম, সাধনপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান এজাজ আহম্মেদ ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
পুস্পস্তবক প্রদান শেষে খোরশেদ আলম দেশ বর্তমানকে বলেন- নারকীয় ১১ জন সংখ্যালগু হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার না হওয়া খুবই দুঃখজনক। তিনি চাঞ্চল্যকর হত্যার বিচারকার্য সম্পাদন করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন এবং ঘটনার পর পর বসানো অস্থায়ী পুলিশক্যাম্পকে স্থায়ীকরনে ব্যবস্থাগ্রনের অনুরোধ জানান।